Update 32

আপডেট ২১



জেবার সাথে কথা বলার পর থেকেই মাহফুজের একটু নির্ভার লাগছে। ওর মাথার ভিতর থাকা প্ল্যানটা এক্সিকিউট করবার জন্য কি রাস্তা ব্যবহার করা যায় সেটা ঠিক করে উঠতে পারছিল না। জেবার সাথে ওর দুই দিনের কথোপকথন আসল রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়েছে ওকে। মাহফুজ রাজনীতির মাঠে নতুন খেলয়াড় না। বয়স কম হলেও ওর বেড়ে উঠা রাজনৈতিক পরিবারে। নানা এবং বাবা দুইজনে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করছে বহু বছর। মাহফুজদের বাসায় প্রায় বিভিন্ন রাজনৈতিক মিটিং হয়। তাই ছোটবেলা থেকে রাজনৈতিক পরিবেশে বড় হওয়ায় কিভাবে প্রতিপক্ষ কে স্ট্রাটেজিক্যালি মোকাবেলা করতে হবে তার একটা প্রাথমিক ধারণা ওর ছিল। এরপর কলেজ থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়েছে। ভার্সিটির প্রথমবর্ষে রাজনীতির সাথে সম্পর্ক আর গভীর হয়েছে ওর। সেই সময় থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক কূটচালের কখনো শিকার আর কখনো প্ল্যানকারি হিসেবে মাহফুজের অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে। এইসব অভিজ্ঞতা থেকে মাহফুজ জানে প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হলে তার সাথে সরাসরি লড়াই করা বোকামি। সেখানে আড়াল থেকে লড়তে হয়, অন্য কাউকে উস্কে দিতে হয় লড়ায়ে। অনেক সময় প্রতিপক্ষ যাকে তুমি সরাসরি শত্রু বানাতে চাও না, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে হারাতে চাও। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল উপায় হল একটা কৃত্রিম সংকট তৈরি করা সেই প্রতিপক্ষের জন্য। সংকটটা এমন ভাবে তৈরি করতে হবে যাতে সেখানে তোমার হাত আছে বুঝা না যায়। এরপর সেই সংকটে প্রতিপক্ষ ভালভাবে জড়িয়ে পড়লে উপস্থিত হতে হবে ত্রাতার ভূমিকায়। বিপদ থেকে উদ্ধার করে ঋণী করে ফেলতে তোমার কাছে। অনেকটা সর্প হইয়া দংশন কর, ওঝা হইয়া ঝাড় টাইপ ব্যাপার।

ভার্সিটি লাইফ থেকে শুরু হওয়া ওর মূল রাজনৈতিক জীবন আজ পর্যন্ত ধরলে প্রায় এক যুগ। এত দিনে এই টেকনিক বেশ কয়েকবার ব্যবহার করেছে এবং সাফল্যের হার খুব একটা খারাপ না। সিনথিয়ার সাথে ওর বিয়ের জন্য নুসাইবা-আরশাদের আর্শীবাদ দরকার ওর, আবার বর্তমান পরিস্থিতিতে এই আর্শীবাদ পাওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। তাই সোজা রাস্তা না ধরে ওকে বাকা রাস্তা ধরতে হচ্ছে। এমন কোন একটা সংকট ওকে সৃষ্টি করতে হবে যেটার কারণে আরশাদ-নুসাইবা বিপদে পড়ে বা বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। সংকটের শুরুতে কোন হেল্প করা যাবে না যাতে সংকট আর ঘনীভূত হয়। এরপর যখন নুসাইবা-আরশাদ অস্থির হয়ে উঠবে তখন সহায়তা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। মানুষ যখন দিশেহারা হয় ঠিক তখন সামান্য সাহায্য মানুষ কে অনেক বেশি কৃতজ্ঞ করে তুলে। নুসাইবা আর আরশাদ দুইজনের মধ্যে নুসাইবার চাকরি বাংলাদেশের ব্যাংকে, মূলত রিসার্চ সেকশনে। সেখানে মাহফুজের দৌড় এখনো পৌছায় নি। আর বাকী থাকে আরশাদ। আরশাদ বড় অফিসার হলেও চাকরির ন্যাচারের কারণে প্রচুর পাবলিক ডিলিংস করতে হয়। সেই কারণে আরশাদ কে টার্গেট করা ইজি। সেটাই মাহফুজ করেছে। আর নুসাইবা যেভাবে জামাই অন্তপ্রাণ তাতে আরশাদ কে কোন বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারলে নুসাইবার মন পাওয়া কঠিন হবে না। আর কোন সংকট সৃষ্টি করতে গেলে যাকে বিপদে ফেলতে হবে তার এবং তার পরিপার্শ্বিক সম্পর্কে ভাল ধারণা থাকা উচিত। এই তথ্য সংগ্রহের খেলাটা শুরু হয়েছিল সোলায়মান শেখ কে দিয়ে। সিনথিয়ার কাছ থেকে শোনা বিভিন্ন তথ্য আর পিকনিক বা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পিচ আয়োজন করতে গিয়ে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে বেশ অনেক তথ্য জানলেও এইসব তথ্য গুলো কি ঠিক কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেটাই মাথায় কাজ করছিল না। জেবাই ওকে রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছে।

আরশাদ টাকা খায় এটা সোলায়মান শেখ ইংগিত দিয়েছিল তবে সরাসরি প্রমাণ করার উপায় ছিল না। আর সোলায়মান শেখ সে ঝামেলায় জড়াতে চাইছিল না। সরকারি অফিসে নানা খবর বের করে মেহদী তাকেও কাজে লাগিয়েছিল মাহফুজ তবে সেও ব্যর্থ। সেখানে জেবাও না জেনে ওকে আসল জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছে। সানরাইজ গ্রুপ। সানরাইজ গ্রুপ দেশের একটা বড় উদ্যোক্তা গ্রুপ। ব্যবসায়ী আনোয়ার খান আর তিন ছেলে মিলে চালান এই গ্রুপ। বড় একটা ব্যবসায়ী গ্রুপ। আনোয়ার খান শুরু করেছিলেন বিড়ির বিজনেস দিয়ে কালে কালে সেটা অনেক বড় ব্যবসায় দাড়িয়েছে। সেখান থেকে পাওয়া টাকায় গার্মেন্টস, ঔষুধ তৈরির কারখানে। আর বিদেশ থেকে নানা শিল্প যন্ত্রের খুদ্রাংশ আমদানির এক বিশাল ব্যবসা দাড় করিয়েছে পরে তিন ছেলে কে সাথে নিয়ে। সানরাইজ গ্রুপ বিড়ি ছাড়া আর যা তৈরি করে তার খুব ক অংশ তারা দেশে বিক্রি করে। বেশির উতপাদিত পণ্য তারা দেশের বাইরে বিক্রি করে। আর খুচরা যে যন্ত্রাংশ তার বিক্রি করে সেটার ক্রেতাও বড় শিল্প কলকারখানা। তাই খুব বেশি একটা বিজ্ঞাপন দেয় না সানরাইজ গ্রুপ। তাই তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার সাথে তুলনা করে অত বেশি মানুষ সানরাইজ গ্রুপ সম্পর্কে জানে না। মাহফুজও অত ভাল করে জানত না তবে কিছুটা এখন জানে একটা বিশেষ কারণে। সানরাইজ গ্রুপের মালিক আনোয়ার খানের বড় ছেলে আজিম খান রাজনীতিতে আছেন। আর ভাল করে বললে সংসদ নির্বাচনে দাঁড়িয়ে এমপি হতে চান এবং সেটা মাহফুজদের দল থেকে। সেই কারণে খালেদ চাচার কাছে প্রায়ই আসেন। ওদের দলের ভিতরকার গ্রুপিং এ খালেদ চাচা যে উপদলের মধ্যে আছেন আজিম খান সেই উপ-দলের সমর্থন নিয়ে সামনে নির্বাচনে নমিনেশন জিততে চান। বড় ব্যবসায়ী সেই সূত্রে খালেদ চাচাদের ফান্ডের একটা বড় উৎস এই আজিম খান। তাই খালেদ চাচার এখানে আসলেই ভাল খাতির যত্ন পান। মাহফুজ যেহেতু খালেদ চাচার সাথে সাথে সাথে উনাকে প্রটোকল দেবার জন্য তাই আজিম খান আর সানরাইজ গ্রুপের ব্যাপারটা জানে। মাহফুজ জানে আজিম খান যখন নির্বাচনী নমিনেশন পাওয়ার জন্য মরিয়া সেই সময় আরশাদ আর সানরাইজ গ্রুপের ভিতর ডিলিং এর খবর টা কতটা সেনসেটিভ হতে পারে। এখন এই ইনফরমেশন ঠিক ভাবে কাজে লাগানো টা ইম্পোর্টেন্ট।



অফিস থেকে ফিরে এসে আরশাদ আর নুসাইবা গল্প করছিল। অফিস থেকে ফেরত আসলে দুইজনে প্রায় চা খেতে খেতে বারান্দায় বসে গল্প করে। আজ সারাদিন কি হল এটা নিয়ে। মাঝে নুসাইবা বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যায় বা আরশাদ ক্লাবে যায় অথবা যেসব দিনে অফিসে ছুটির পরেও কাজ করতে হয় সেই সব দিন বাদ দিলে এটা মোটামুটি রুটিন। এই সময় সাধারণত কেউ আসে না বা আসলেও ফোন করে আস। তাই কলিংবেলের শব্দে দুই জনেই অবাক হল। এই সন্ধ্যায় কে এল? দরজা খুলতেই দেখে রিয়াদ দাঁড়িয়ে আছে হাসি মুখে। ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে আরশাদ আর নুসাইবা দুই জনকেই বলল সুখবর আছে। আজকে তাই অফিস থেকে বের হয়েই তোদের এখানে প্রথম এসেছি, এই বলে একটা প্যাকেট নুসাইবার হাতে ধরিয়ে দেয়। নুসাইবা জিজ্ঞেস করে এটা কিসের প্যাকেট। রিয়াদ বলে খুলেই দেখেন ভাবী। নুসাইবা খেয়াল করে দেখে মিষ্টির প্যাকেট। কারণ জিজ্ঞেস করতেই বিশাল একটা হাসি দিয়ে বলে ছেলে কে তো গর্ভমেন্ট ল্যাবরেটরি কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে ফেলছি। আরশাদ আর নুসাইবা দুইজনেই শুনে খুব খুশি হয়। রিয়াদ আর জেবার ছেলে মেয়ে দুইটাকে ওরা আসলেই খুব স্নেহ করে। এইবার আরশাদ চেষ্টা করলেও ভর্তি করাতে পারে নি। সেই সময় জেবা আর রিয়াদের মন খারাপ দেখে আরশাদের খারাপ লেগেছিল। তবে কিছু করার ছিল না। বেশির ভাগ সিট চলে যায় এই কলেজে মেরিট লিস্টে ভর্তি পরীক্ষায় যারা চান্স পায় তাদের জন্য। আর কিছু থাকে বিভিন্ন কোটা। আর থাকে কিছু সিট হেডমাস্টারের হাতে, প্রভাবশালীদের তদবির রক্ষার জন্য। মন্ত্রী, এমপি, বড় ব্যবসায়ী, বড় সরকারী অফিসার, নানা সেলেব্রেটি সবাই যার যার মত চেষ্টা করে ঢাকার মধ্যে ছেলেদের অন্যতম ভাল এই কলেজে একটা সিট ম্যানেজ করতে। আরশাদ ট্যাক ক্যাডারে বড় অফিসার হলেও আসলে সরকারী অফিসারদের বিচারে এখনো যথেষ্ট উপরে উঠে নি। তাই এত এত তদবিরের ভীড়ে ওর তদবির হারিয়ে গিয়েছিল। রিয়াদের ছেলেটাকে ভর্তি করাতে পারে নি। রিয়াদ যে খালি আরশাদের বেস্ট ফ্রেন্ড তা না, ওর নানা রকম কথা শেয়ার করার আর নানা কর্মকান্ডের পার্টনার। তাই এইবার আরশাদ একটা প্রতিজ্ঞা নিয়েছিল আগামী বছর যে করেই হোক রিয়াদ জেবার ছেলেটাকে গর্ভমেন্ট ল্যাবরেটরি কলেজে ভর্তি করাবে। ওর অফিসে ট্যাক্সের কাজে প্রচুর হোমরা চোমড়া লোকজন আসে। এইবার এরকম কাউকে বলবে তার কাজের বিনিময়ে একটা কাজ করে দিতে হবে। গর্ভমেন্ট ল্যাবরেটরি কলেজে একটা সিট ম্যানেজ করে দিতে হবে। ব্যাপারটা যদিও রিয়াদ আর জেবা কে খুলে বলে নি। ভেবেছিল একটা সারপ্রাইজ দিবে। তাই এই খবর শুনে আরশাদ দারুণ খুশি হল। তবে সেই সাথে মনে একটা প্রশ্ন আসল। রিয়াদ সব সময় যে কোন তদবিরের কাজ হলে ওর কাছে আছে। আরশাদ সম্ভব হলে নিজে করে দেয় অথবা এমন কার সাথে লিংক আপ করে দেয় যে করে দিতে পারবে। রিয়াদ ওর সাথে যোগাযোগ ছাড়াই কিভাবে ছেলেকে ভর্তির ব্যবস্থা করে ফেলল?

নুসাইবা রিয়াদের ছেলের খবর শুনে দারুণ খুশি হয়েছে। কংগ্রেটস বলতে বলতে বলল, শুধু মিষ্টি খাওয়ালে কিন্তু হবে না খালি রিয়াদ ভাই, একটা ট্রিট দেওয়া লাগবে। রিয়াদ হাসতে হাসতে বলল সেটা আর বলতে হবে না। যেখানে চান সেখানে ট্রিট দেওয়া হবে ভাবী। আরশাদ এর মাঝে বলল, কিভাবে ভর্তি করালি তুই? কাকে ধরেছিস? তোদের এমডি আজিম খান কে ধরেছিলি নাকি? উনাদের পলিটিক্যালি আর ফিনিন্সিয়ালি দুইভাবেই অনেক ক্ষমতা। আমাদের প্রথমবারেই উনাদের কে রিকোয়েস্ট করা উচিত ছিল। রিয়াদ বলে না, না। আজিম স্যার বা আনোয়ার স্যার কাউ কে রিকোয়েস্ট করি নি। তুই তো জানিস উনারা ঠিক এমপ্লিয়িদের পার্সনাল ম্যাটারে মাথা ঘামাতে চান না। আরশাদ অবাক হয়। সাইরাইজ গ্রুপের মালিক বা মালিকের ছেলে ছাড়া আর কোন প্রভাবশালী লোকের সাথে রিয়াদের যোগাযোগ আছে। তাই প্রশ্ন করে, তাহলে কাকে ধরলি? রিয়াদ বলে আরে আমি কিছুই করি নি। যা করার জেবা করেছে। জেবার নাম শুনে আরশাদ আর নুসাইবা দুইজনেই সোজা হয়ে বসল। জেবা কে দুইজনেই পছন্দ করে। বন্ধুর বউ এবং ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র হিসেবে খুব স্নেহ করে কিন্তু ওরা দুই জনেই একমত জেবা প্রফেশনালি খুব একটা চালাক চতুর না। তাই আরশাদ যে কাজ করতে পারে নি সেই কাজ রিয়াদ নয় বরং জেবা করে ফেলেছে শুনে আরশাদ- নুসাইবা দুই জনেই একটু নড়েচড়ে বসে। রিয়াদ, আরশাদ এবং জেবার মুখে অবাক হবার চিহ্ন দেখে তাই বলে, আমিও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারি নি। জেবা দুই দিন আগে বলেছিল ভর্তির একটা উপায় নাকি ও বের করেছিল। তুই তো জানিস জেবা ভাল মেয়ে কিন্তু প্রফেশনালি অত স্ট্রং না। তাই আমি অতটা পাত্তা দেই নি। ছেলেটার কলেজে চান্স না হবার পর থেকেই জেবা এটা নিয়ে প্রায় মন খারাপ করে থাকত। আমি ভেবেছিলাম হয়ত অফিসে আসা কোন ক্লায়েন্ট বা ওদের অফিসের কেউ হয়ত কোন আশ্বাস দিয়েছে। লোক জন কাজ আদায় করার জন্য এমন কত আশ্বাস দেয় তুই তো জানিস। আরশাদ আর নুসাইবা দুই জনেই হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়। রিয়াদ বলছে, আমি তাই বলেছিলাম সাবধান। অনেক রকম ফ্রড থাকে। অনেকে এইসব বলে টাকা খায়। এরপর জেবা আর কিছু বলে নি আমিও ভুলে গেছিলাম। আজকে সকালে জেবা যখন ফোন দিয়ে বলল ছেলেটার ভর্তির ব্যবস্থা হয়ে গেছে, তখনো বিশ্বাস করতে পারি নি। পরে আমাকে ভর্তি ফরমের ছবি পাঠাল। কি যে খুশি লাগছে দোস্ত। রিয়াদ খুশির চোটে জেবার অনেক প্রশংসা করে যেতে থাকে। নুসাইবা আর আরশাদ দুইজনেই মাথা নাড়ায় প্রশংসাসূচক কথায় তবে দুইজনের মাথায় তখন ঘুরছে জেবা কিভাবে কাজটা করল। নুসাইবা কৌতুহল চেপে রাখতে পারে না। তাই প্রশ্ন করে, রিয়াদ ভাই জেবা কাজটা কার মাধ্যমে করল?

রিয়াদ বলে, দেখেছেন কান্ড! আরশাদ একটু আগে জিজ্ঞেস করল আমি বিভিন্ন কথা বলতে গিয়ে তো আসল কথাটাই বলতে ভুলে গেছি। আপনারা তো চিনেন। মাহফুজ? আপনারাই তো বলে ওর সাথে জেবার পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। মাহফুজ বলে ছেলেটাই নাকি হেল্প করেছে ভর্তির ব্যাপারে। আরশাদ আর নুসাইবা প্রথমে দুইজনেই বুঝে উঠতে পারে না কোন মাহফুজের কথা বলছে রিয়াদ। কারণ ওদের কোন হিসাবেই জেবা মাহফুজের মাধ্যমে কলেজে ছেলে কে ভর্তি করাবে। তাই কয়েক সেকেন্ড লাগে দুইজনের বুঝতে কোন মাহফুজ। আরশাদ প্রশ্ন করে এবার, কোন মাহফুজ? রিয়াদ বলে, আরে, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ছেলেটা। তোদের ডিপার্টমেন্টের পিকনিক যারা আয়োজন করল। আরশাদ নুসাইবা দুই জনেই এত অবাক হয় যে কোন উত্তর দেয় না। আরশাদ নুসাইবা দুইজনে দুই জনের দিকে তাকায়। দুই জনের চোখেই অবিশ্বাস। নুসাইবা এইবার বলে উঠে, পিকনিকের দ্বায়িত্বে থাকা মাহফুজ? একি সাথে প্রশ্ন আর উত্তর দুইটাই যেন ওর কথায়। রিয়াদ মাথা নাড়ায়, হ্যা। নুসাইবা মেনে নিতে পারে না। ওর স্বামী যা পারে নি আরকেটা কম বয়েসী ছেলে সেটা করে ফেলেছে। তাই অনেকটা খোচার সুরে জিজ্ঞেস করে, অনেক টাকা খরচ করতে হয়েছে নিশ্চয়? কত টাকা দিতে হল মাহফুজ কে? রিয়াদ হেসে বলে, নাহ ভাবী। কোন টাকাই খরচ করতে হয় নি। ওর সাথে নাকি কোন বড় নেতার পরিচয় আছে। উনাকে রিকোয়েস্ট করে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আর জেবা কলেজের হেডমাস্টারের অফিসে যাবার পর মাহফুজের রেফারেন্স শুনে হেডমাস্টার নাকি অনেক খাতির যত্ন করেছে। নুসাইবার বিশ্বাস হতে চায় না। আরশাদ ভাবে ও মাহফুজ সম্পর্কে যা খোজ নিয়েছিল সেগুলো তাহলে সত্য। ছেলেটা পলিটিক্যালি ওয়েল কানেক্টেড এবং খুব শার্প। ওর অফিসে আসা এক নেতা বলেছিল মাহফুজ কে কোন দ্বায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা যায়। যে কোন ভাবেই ছেলেটা কাজটা আদায় করে আনবে। আরশাদের তাই মনে হয় বাসায় দাওয়াত দিয়ে একদিক দিয়ে ভাল করেছে নুসাইবা। ছেলেটার সাথে আরেকটু সম্পর্ক ভাল করা যাবে। আর নুসাইবা কেও একটু সফট খেলতে বলতে হবে। এই ছেলে ফুলটস বল দেবার লোক না বুঝা যাচ্ছে। তাই মাহফুজ কে এলবিডাব্লিউ এর ফাদে ফেলতে গিয়ে নিজেরা ইয়ার্কারের ফাদে পড়ার চান্স আছে। তাই দাওয়াতে ওদের প্ল্যানটা আর সুক্ষ ভাবে করার জন্য নুসাইবা কে বলতে হবে বা পারলে কিছু দিনের জন্য প্ল্যানটা বন্ধ রাখতে হবে।

এদিকে নুসাইবা মাহফুজ কোন টাকা ছাড়া কাজটা করেছে শুনে কি বলবে ভেবে পায় না। হাউ ইজ ইট পসিবল? কি না কি পলিটিক্স করে সে ছেলে কাজটা করে ফেলল? তাও কোন টাকা ছাড়া? নুসাইবা অংক মেলাতে পারে না। একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি নাহয় চালায় অথবা টেন্ডারের কিছু বিজনেস না হয় আছে তাই বলে আরশাদ কে টক্কর দিয়ে এভাবে ভর্তি করিয়ে ফেলতে পারল ছেলেটা? সহ্য হয় না নুসাইবার। গায়ে যেন সুক্ষ একটা জ্বলুনি চলতে থাকে। নুসাইবা বলে জেবার মাহফুজ কে রাজি করাল কিভাবে এই কাজ করতে? রিয়াদ বলে ভাবী আই হ্যাভ নো আইডিয়া। জেবার মত সহজ সরল মেয়ে এইভাবে বিনা টাকায় প্রায় বিনা তদবিরে এই কাজ করতে পেরেছে তাতে আমি খুব অবাক হয়েছি। তবে মাহফুজ সাহেবের সাথে আমার কথা হয়েছে। ভদ্রলোক ইজ রিয়েলি এ জেন্টলম্যান। খুব অমায়িক। নুসাইবা টের পায় ওর শরীরের সুক্ষ জ্বলুনি যেন আর বাড়ছে। রিয়াদ বলে তবে জেবা কাজটা কিভাবে করেছে এটা মনে হয় জেবাই ভাল বলতে পারবে। নুসাইবা কৌতুহল চেপে রাখতে পারে না। তাই বলে ভাই বসেন, আমি ভিতর থেকে চা করে আনছি। আরশাদ আর রিয়াদ দুই বন্ধু কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নুসাইবা ভিতরে ঢুকে কেতলিতে পানি বসাতে বসাতে জেবা কে ফোন করে। দুই রিং এর পর জেবা ফোন ধরে বলে, আপা স্লামালাইকুম। নুসাইবা বলে কংগ্রেচুলেশন। জেবা খুব খুশি হয়। নুসাইবার কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া সহজ কথা না। আর নুসাইবার প্রতি ভিতরে ভিতরে জেলাসি থাকলেও এক ধরণের মুগ্ধতা যে ভার্সিটি জীবন থেকে আছে সেটাও মিথ্যা না। তাই নুসাইবার যে কোন প্রশংসা জেবার কাছে আলাদা কদর পায়। নুসাইবা হালকা পাতলা দুইটা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলার পর আসল প্রসংগ তুলে। মাহফুজের সাথে জেবার পরিচয় কীভাবে আর মাহফুজ ভর্তি করাল কিভাবে। জেবা অবাক হয়। নুসাইবা অনেক সময় আশেপাশের অনেক জিনিস খেয়াল করে না সেটা আগেও লক্ষ্য করেছে। মাহফুজের সাথে তো নুসাইবার সামনেই এলমনাই এসোশিয়েশনের অফিসে পরিচয় হল। তারপর মাহফুজ যে ব্যান্ড দল ঠিক করে দিল সেটা নিয়ে তো নুসাইবার সাথেই আলোচনা হল। জেবা তাই উত্তর দিল, কেন আপা আপনার সামনেই না পরিচয় হল আমাদের এলমনাই অফিসে। নুসাইবা বলে, ওহ! তাই তো! ভুলে গেছিলাম। নুসাইবা প্রশ্ন করে তাহলে তুমিই ওকে বলেছিলে ভর্তির একটা ব্যবস্থা করতে? জেবা বলে নাহ, আপা। এটাই আশ্চার্যজনক ঘটনা। ছেলে কে ভাল কলেজে ভর্তি করাতে চাই এটা কথায় কথায় বলেছিলাম। মাহফুজ ভাই তখন নিজে থেকেই বলল উনি হেল্প করতে পারবে। আমি একটু ডাউটে ছিলাম। আসলেই পারবে কিনা। আরশাদ ভাই পর্যন্ত যেখানে পারে নাই। জেবা ইচ্ছা করেই শেষ লাইনটা বলে। নুসাইবা কে একটু খোচা দেবার জন্য। নুসাইবার গায়ের জ্বলুনি তখন আর বাড়ে। জেবা বলে, মাহফুজ ভাই আসলেই খুব ভাল লোক। এই যুগে কে এমন কাউকে কোন কারণ ছাড়া হেল্প করে। নুসাইবা আর বিস্তারিত জানতে চায়। জিজ্ঞেস করে, কাকে বলেছে মাহফুজ কলেজে ভর্তির জন্য। জেবা যদিও জানে স্থানীয় থানার সভাপতির ফোনে কাজ হয়েছে তাও নুসাইবা একটু জ্বালানোর সুযোগ ছাড়ে না। এমন সুযোগ তো দশ বছরে একবার পাওয়া যায় না। জেবা তাই বলে, আমি ঠিক জানি না, কোন এক মন্ত্রী কে নাকি ধরেছে মাহফুজ। আর আমরা হেডমাস্টারের রুমে যাবার পর যা খাতির যত্ন করল। কলেজে ভর্তি তো করালোই সাথে দুপুর লাঞ্চ করাতে চেয়েছিল। জেবা একটু বাড়িয়ে বলে। এমনিতে সহজ সরল ভাল মানুষ হিসেবে পরিচয় আছে জেবার, তাই জেবার কথা বিশ্বাস করে নুসাইবা। তাতে আর অবাক হয়, মাহফুজের মন্ত্রী পর্যন্ত দৌড় আছে। একদম পাড়ার ছোটখাট নেতা না তাহলে। জেবা এরপর মাহফুজের আর অনেক প্রশংসা করে যায় ইচ্ছা করেই। জেবার মনে হয় এতদিন ওর স্বামী কে ছোট হয়ে থাকা লেগেছে আরশাদ ভাইয়ের জন্য। বিয়ের পর এই প্রথম জেবা দেখছে যেটা আরশাদ ভাই পারে নি সেটা ও করে ফেলেছে। তাই মাহফুজের প্রশংসা করে বেশি বেশি করে। জেবার মনে হয় এতে যেন আরশাদ ভাই ছোট হচ্ছে আর আরশাদ ভাই যত ছোট হবে রিয়াদ তত বড় হচ্ছে। জেবার ভাবা কথাটাই যেন নুসাইবার মনে ঘুরছে। আরশাদ যে কাজ করতে পারে নি সেই কাজ মাহফুজ করে ফেলেছে। তবে যতবার কথাটা মাথায় ঘুরে তত বেশি যেন গায়ের মাঝে জ্বলুনি টের পায় নুসাইবা।

সেই রাতে শোয়ার সময় নুসাইবা আর আরশাদের মাঝে কথা হয়। নুসাইবা আরশাদ দুইজনের কেউ যেন মেনে নিতে পারছে না মাহফুজ রিয়াদের ছেলে কে কলেজে ভর্তি করিয়ে ফেলেছে। অনেক এংগেল থেকে নুসাইবা আরশাদ ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করে। তবে যত বিশ্লেষণ করুক সত্য হল মাহফুজ ভর্তি করার ব্যাপারে সফল। না চাইলেও ব্যাপারটা মেনে নিতে হয় দুই জন কে। আরশাদ বলে আমরা মাহফুজ কে যত সহজ ভেবেছিলাম অত সহজ না ছেলেটা। অনিচ্ছা স্বত্তেও স্বামীর কথা মেনে নিতে হয় নুসাইবার। আরশাদ বলে দেখ, মাত্র চৌদ্দ দিনের ভিতরে কিভাবে আমাদের পিকনিকের আয়োজন করে ফেলল। নুসাইবা ক্ষীণ প্রতিবাদ করে বলে, আমরা তো আগে থেকেই ভেন্যু ঠিক করা, টাকা তোলা এইসব করে ফেলেছিলাম। আরশাদ বাস্তববাদী। তাই বলে, দেখ মাত্র চৌদ্দ দিনে কোন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি এই কাজ করত না। মাহফুজ কে কাজটা দেবার আগে এক সাপ্তাহ আমি অন্তত আর তিন চার জায়গায় ফোন দিয়েছি। সবাই তখন হাতে ২১ দিন সময় থাকার পরেও নানা ব্যস্ততার অযুহাত দেখিয়ে কাজটা নেয় নি। আর মাহফুজ আমাদের কাজটা করে দিয়েছে খুব কম টাকায়। এত কম টাকায় করে দেবার কারণেই আমরা ফুড মেনু আর ভাল দিতে পেরেছি। নুসাইবা বলে ও কি এমনি এমনি দিয়েছে, ও জানে আমাদের মন পাওয়া দরকার সিনথিয়ার জন্য। তাই এটা করেছে। আরশাদ বলে সেটা ঠিক। তবে জেবার জন্য কাজটা করল কেন? মাহফুজের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না নুসাইবা। ছেলেটা কি আসলেই খুব ভাল। মানুষ কে দরকার পরলে সাহায্য করে? আরশাদের মনেও তখন একই প্রশ্ন। আরশাদ বলে দেখ, নুসাইবা আমাদের মনে হয় মাহফুজ সম্পর্কে আমাদের প্ল্যানটা আর ভাল করে ভেবে দেখা দরকার। মাহফুজ তোমার কাজিনের মত অত সহজ ছেলে না। ওকে আমাদের প্ল্যান মোতাবেক রাস্তায় আনা সহজ হবে না। আবার এখন মনে হচ্ছে ছেলেটা হয়ত অত খারাপ হবে না সিনথিয়ার জন্য। নুসাইবা চোখ গরম করে তাকায়। আরশাদ বলে, আরে রাগ করছ কেন। ভেবে দেখ। ছেলেটার ভাল ব্যবসা আছে, পলিটিক্যালি কানেক্টেড। তোমাদের ফ্যামিলিতে সবাই ভাল বড় কর্পোরেট জব করে বা সরকারি চাকরি করে। কিন্তু এই যুগে পরিবারে কিছু পলিটিক্যাল কানেকশন না থাকলে লাভ হয় না। ছেলেটা অত খারাপ মনে হয় না। যেভাবে জেবাদের হেল্প করল। আরশাদের কথা গুলো নুসাইবা ফেলে দিতে পারে না আবার ঠিক মেনেও নিতে পারে না। সদা আত্মবিশ্বাসী নুসাইবার মনে সে রাতে একটা সংশয়ের তৈরি হয়। সংশয়ের নাম মাহফুজ। ছেলেটাকে নিয়ে আসলে কি করা যায়? আরশাদ যা বলেছে সেটা মিথ্যা না। ছেলেটা হ্যান্ডসাম, ভাল প্রসপেক্ট আছে ফিউচারে কিন্তু ছেলেটার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ঠিক ওদের স্টান্ডার্ডের না। আদরের ছোট ভাতিজি কে কি এই ছেলের হাতে তুলে দেওয়া যায়? সে রাতে নুসাইবার সংশয়ের নিষ্পত্তি হয় না।



বাবা মায়ের দেওয়া ভাল নাম মোহাম্মদ আজাদুর রহমান। মফস্বলের ছেলে। ঢাকায় এসেছিল পড়াশুনা করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল বাংলা বিভাগে। লেখালেখির শখ ছিল কলেজ জীবন থেকেই। তার উপর ভর্তি পরীক্ষায় রেজাল্ট খুব একটা ভাল হয় নি তাই সাবজেক্ট হিসেবে বাংলা কে পারফেক্ট মনে হয়েছে। সাহিত্য পছন্দ করলেও বাংলা বিভাগে ক্লাসে কখনো নিয়মিত ছিল না আজাদুর রহমান। শুরু থেকেই স্বপ্ন ছিল ঢাকায় এসে নাম যশ করবে লেখালেখি দিয়ে। তাই লিটল ম্যাগ করা, পত্রিকায় লেখা পাঠানো ছিল নিয়মিত কাজ। উঠতি বয়সি লেখক হতে চাওয়া ছেলে মেয়েদের আড্ডায় সময় দিত সব। ক্লাসে তখন সময় দেবার সময় নেই। ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরা কিছু বললে বলত, দেখিস একদিন আমার লেখা নিয়ে এই ডিপার্টমেন্টের স্যাররা ক্লাসে আলোচনা করবে। ঢাকায় প্রতি বছর আসা হাজার হাজার মফস্বলের ছেলের মত আজাদুর রহমান স্বপ্ন দেখেছে এবং বাকি অনেকের মত স্বপ্নটা অধরাই রয়ে গেছে। সময়ের সাথে বুঝতে পেরেছে লেখালেখির হাত খুব সাধারণ তার। লিখে খুব বড় কিছু হওয়া যাবে না। যতদিনে এটা বুঝতে পেরেছে ততদিনে অনেক সময় চলে গেছে। অনার্স পরীক্ষা শেষ মাস্টার্সের ক্লাস চলছে। রেজাল্ট অনেক খারাপ। ক্লাসের শেষ থেকে দশ জনের মধ্যে রেজাল্ট। ইংরেজিতে চিরকার দূর্বল তাই বিসিএস বা ব্যাংকের চাকরির পরীক্ষায় ভাল করার চান্স কম। শুরুতে এসে স্বপ্ন দেখে সময় নষ্ট করলেও আজাদুর রহমান এমনিতে বোকা না। অবশ্য আজাদুর রহমানের নাম ততদিনে আজাদুর রহমান নাই। লেখক হতে চাওয়া আর অনেক কম বয়েসি ছোকড়াদের মত নাম চেঞ্জ করে ফেলেছে। আজাদুর রহমান তখন অমিত আজাদ। শেষের কবিতার অমিত আর আজাদুরের আজাদ। দুই মিলে অমিত আজাদ। অমিত আজাদ নামটায় একটা আভিজাত্য আছে। মফস্বলের সব গন্ধ যেন চলে যায় এই নাম উচ্চারণ করলে। তবে অমিত আজাদ যখন টের পেল সাহিত্যের বাজারে তার ভাত নাই ততদিনে পড়াশুনার বাজারে আসন গেড়ে বসবার জন্য বড় দেরি হয়ে গেছে। আর ইংরেজিতে দূর্বলতার কারণে চাকরির গাইড বই নিয়ে বসবার ইচ্ছাটাই হয় নি কখনো।

তাই আর অনেক সাহিত্যে ব্যর্থ হওয়া যুবকের মত অমিত আজাদ বেছে নেয় নেক্সট বেস্ট থিং। সাংবাদিকতা। ঢাকা শহরে সাহিত্যিক হতে চাওয়া ব্যর্থ যুবকদের একটা বড় অংশ সাংবাদিকতা কে বেছে নেয় জীবিকার জন্য। তাই ঢাকা শহরে সাংবাদিকদের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় একটা বড় অংশ জীবনের কোন একটা সময় কবি সাহিত্যিক হতে চেয়েছিল। সাহিত্যিক হতে চেয়ে ব্যর্থ হওয়া অমিত আজাদ তাই সাংবাদিকতা শুরু করে। সাংবাদিকতায় কোন পড়াশুনা বা অভিজ্ঞতা ছিল না তাই বড় কোন নিউজ হাউজে চাকরি জুটে নি। শুরু করেছিল অনলাইন পত্রিকাগুলোতে কন্ট্রিবিউটর হিসেবে। লেখা জমা দিলে তবে টাকা। সেখান থেকে আজ অনেক দূর এসেছে অমিত আজাদ। দেশের একটা মাঝারি পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার অমিত আজাদ। চল্লিশের মত বয়স হয়েছে। গত তের চৌদ্দ বছর সাংবাদিকতার লাইনে হেটে হেটু ঝানু হয়েছে। আগেরকার মত স্বপ্নালু আর নেই। বাস্তবতা বড় কঠিন এটা জানে অমিত আজাদ। তাই সে অনুযায়ী এই শহরে স্বপ্ন ব্যাগে ভরে লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটু একটু করে পচা পানিতে গা ভিজিয়েছে। খবর সংগ্রহ করার জন্য যে কোন উপায় অমিত আজাদের কাছে অনৈতিক না। হাজার হাজার সাংবাদিকের ভিড়ে একটা ভাল নিউজ হাউজে কাজ জোটানো সহজ নয়। নিয়মিত ভাল ভাল রিপোর্ট জোগাড় করতে না পারলে এই জায়গায় আজ আসতে পারত না। অমিতের স্পেশালিটি পলিটিক্যাল বিট। রাজনৈতিক রিপোর্টার হিসেবে অমিত চৌকষ। কাকে কিভাবে পটিয়ে কথা বের করতে হবে সেই ব্যাপারে অমিতের জুড়ি নেই। আর মাহফুজের সাথে অমিতের পরিচয় পলিটিক্যাল নিউজ করতে গিয়ে।

মাহফুজ আর অমিতের সম্পর্কটা আসলে বলা যায় উইন উইন রিলেশন। দুইজনেই এই রিলেশনে স্বার্থ আছে। খালেদ চাচার সাথে নিয়মিত ঘোরার কারণে অনেক পলিটিক্যাল স্কুপ আগেই টের পায় মাহফুজ তাই সেই গুলার আভাস পাওয়ার জন্য মাহফুজ কে দরকার অমিতের। আর পলিটিক্যাল বিটের নিউজ করার কারণে অমিতের সাথে পরিচয় আছে বহু নেতার। তাই মাহফুজ ও দরকার মত অনেক খবর বের করতে পারে অমিতের সহায়তায়। এই যেমন মাহফুজ যখন যুব সংঠনের অর্গানাইজিং সেক্রেটারি হল তখন অমিত ওকে হেল্প করেছিল। কমিটি হবে হবে যখন গুঞ্জন তখন এই পদের জন্য হট ক্যান্ডিডেট ছিল মাহফুজের সিনিয়র একজন। মাহফুজ সেটা জানত। তবে অমিত তখন খবর বের করে দিয়েছিল সেই হট ক্যান্ডিডেট অনেক পুরাতন একটা মার্ডার কেসের চার নাম্বার আসামী। এত বড় পদে আসতে গেলে মার্ডার কেসের আসামী হলে সমস্যা। মাহফুজ তাই জায়গামত ওর চ্যানেলে সেই মামলার খবর পৌছে দিয়েছিল। তাই সেই সিনিয়র কমিটিতে সদস্য পদ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল আর মাহফুজ পেয়ে গিয়েছিল অর্গানাইজিং সেক্রেটারির পদ। সেই সিনিয়র জানতেও পারে নি কিভাবে তার এত পুরাতন একটা খবর অন্দরমহলে পৌছে গিয়েছিল। ইনফ্যাক্ট মাহফুজের সাথে এখনো সেই সিনিয়রের ভাল খাতির। এছাড়া বিভিন্ন ফেভার আদান প্রদানের বিনিময়ে নানা সময় পক্ষে বিপক্ষে নিউজ করে দেয় বিভিন্ন জনের এটাও জানে মাহফুজ। তাই সাপ মারা আর লাঠি না ভাংগা পদ্ধতির জন্য অমিত ইজ এ সেফ অপশন ফর মাহফুজ।

সোলায়মান শেখ কে কাজে লাগানোর আগে থেকেই মাহফুজের মাথায় অমিতের নামটা ছিল। তবে অমিত কে কাজে লাগানোর জন্য যে মাল মসলা লাগবে সেটা হাতে ছিল না। সোলায়মান শেখ যখন নিশ্চিত করল আরশাদের জুয়ার অভ্যাস আছে তখন অমিতের সাথে প্রথম এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলেছিল। কথা বলার সময় অবশ্য মাহফুজ একটা হাইপোথেটিক্যাল সিনারিও দিয়েছিল, আরশাদের নাম পরিচয় গোপন করে। সাকুরা বারের ভিতরে টিম টিম আলোতে ড্রিংক করতে করতে অমিত বলেছিল দেখ মাহফুজ আমি তো মেইনলি পলিটিক্যাল বিটের নিউজ করি তবে তুমি বললে আমি এইটা নিয়ে নিউজ করতে পারি তবে তোমার খুব একটা কাজ হবে বলে মনে হয় না। মাহফুজ জিজ্ঞেস করল কেন? অমিত বলল, তুমি খালি বলছ যার কথা উনি জুয়া খেলে তুমি এটা শিওর তবে এর কোন প্রমাণ বা ছবি তোমার কাছে নাই। তার উপর জুয়া খেলা মোরালি খারাপ কিন্তু এর জন্য তুমি একজন সরকারি অফিসারের বিরুদ্ধে পত্রিকায় রিপোর্ট করতে পারবা না। আমার সম্পাদক অন্তত এই রিপোর্ট সরাসরি ছাপাতে দিবে না। এর থেকে অনেক গূরুত্বপূর্ণ খবর আমাদের প্রতিদিন ফেলে দিতে হয় পত্রিকায় জায়গা দিতে না পেরে। তাই তোমার আর কংক্রিট প্রমাণ সহ কিছু লাগবে। সরকারি অফিসারদের বিরুদ্ধে পত্রিকায় রিপোর্টের সবচেয়ে ভাল উপায় হল তাদের দূর্নীতির বা কাজে অদক্ষতার কোন প্রমাণ যোগাড় করা। এগুলা পাবলিক পড়ে বেশি, সম্পাদক দেখলে কোন প্রশ্ন না করেই রিপোর্টটা ছেড়ে দিবে। সেদিন সাকুরা বারে কথা বলতে বলতে মাহফুজ তার পুরো প্ল্যানের খুটিনাটি ছক কষে ফেলেছিল অমিতের সাথে। মাহফুজের দ্বায়িত্ব আরশাদের দূর্নীতির লিংক বা অদক্ষতার কোন প্রমাণ বের করা। এই খবর টা তখন অমিত ছাপানোর ব্যবস্থা করবে তবে আর কিছু ইনভেস্টিগেট করে। তবে আসল ব্যাপার সেখানে না। মাহফুজের লক্ষ্য খালি আরশাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা না। এই রিপোর্ট হলে যে হইচই হবে সেটা থেকে আরশাদ কে উদ্ধার করা। সেটাও অমিতের সাথে কথায় কথায় ঠিক হয়েছে। অমিত রিপোর্ট করে, রিপোর্টের শেষে লিখবে এই ব্যাপারে পত্রিকা আর অনুসন্ধান জারি রেখেছে। এইসব ক্ষেত্রে যা হয় আরশাদ তখন নিশ্চিত ভাবে পত্রিকায় যোগাযোগ করে সেটা বন্ধ করার চেষ্টা করবে। সেখানেই মাহফুজ এন্ট্রি নিবে। মাহফুজ কে কোন ভাবে আরশাদ নুসাইবার কানে খোজ দিতে হবে যে ওর সাংবাদিক মহলে ভাল যোগাযোগ আছে এবং এই ব্যাপারে হেল্প করতে পারবে। তখন অমিতের সাথে একটা মিটিং ফিক্স করিয়ে আরশাদের সাথে একটা মিমাংসার ভান করতে হবে। যাতে অমিতের কিছু অর্থকড়ি যোগ হবে আরশাদের পকেট থেকে। এতে অমিত খুশি। আর আরশাদ খুশি হবে পরের রিপোর্ট বন্ধ করতে পেরে। অমিত প্ল্যানটা শুনে রাজি হয়ে যায়। মাহফুজ চালাক ছেলে এটা অমিত আগে থেকেই জানত। আজকে কথা বলতে বলতে মনে মনে ভাবে মাহফুজ সম্পর্কে যে শোনা যায় কাউকে টার্গেট করলে একদম রুথলেস ভাবে তার পিছনে লাগে সেটা তাহলে মিথ্যা না। ভবিষ্যতে মাহফুজের সাথে কোন রকম ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়া ভাল হবে সেটা মনে মনে ভাবে অমিত। আর এই প্ল্যানেও অমিত খুশি। কারণ কোন ঝামেলা ছাড়াই রিপোর্ট টা করা যাবে। মাহফুজ সব খবর যোগাড় করে দিবে। অমিতের দ্বায়িত্ব হবে খালি একটু যাচাই করা যে ভুলভাল কিছু না আবার ছাপিয়ে ফেলে। আর ছাপানো হলে এরপর টার্গেট আরশাদের কাছ থেকে টাকা নিতেও অমিতের বাধবে না। কারণ অমিত জানে এই সাংবাদিকতার জগতে যারাই টাকা কামাই করেছে তারা লিখে টাকা কামাই করে নি বরং না লেখার জন্য তারা আর বেশি টাকা কামাই করেছে। আর সস্তা মোরালিটি যেদিন থেকে সাহিত্য করার বাসনা ছেড়েছে সেদিন থেকে বাক্সবন্দী করে রেখেছে। এই সাংবাদিকতা করে ঢাকা শহরে ছেলে মেয়েকে নিয়ে ভালভাবে বেচে থাকা সম্ভব না যদি না মাঝে মাঝে দুই একটা করে বড় দাও না মারা যায়। অমিত আর মাহফুজ তাই দুইজনেই নিজেদের ভবিষ্যত স্বার্থউদ্ধারের শুভকামনা জানিয়ে চিয়ার্স করল।



শুক্রবার সকালে এমনিতে নুসাইবা আরশাদ একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে সাড়ে নয়টা দশটার দিকে। অন্যদিন অফিসের জন্য বেশ সকাল সকাল উঠতে হয় দুইজনকেই। আটটার মধ্যে নাস্তা করে বের হয়ে পড়ে। তবে আজকে শুক্রবার, ছুটির দিন হলেও আজকে নরমাল দিনের মত ঘুম থেকে আগে উঠেছে নুসাইবা আরশাদ। দুইজনে মিলে সকালে বাজারে গিয়েছিল। আজকে দুপুরে দাওয়াত দিয়েছে ওরা মাহফুজ আর আফসানা কে। দুইজনের কাউকে অবশ্য অন্যজনের কথা বলা হয় নি। আফসানা একটা প্রাইভেট ব্যাংকে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মাঝে মাঝে অন্য বাংক গুলোয় ভিজিটে যেতে হয় সেখানে আফসানার সাথে পরিচয় হয়েছিল নুসাইবার। ব্যাংকের হেড অফিসে বসে। দারূন কর্মততপর। কর্পোরেট বা ব্যাংকের বাকি মেয়েদের মত সুন্দরী, স্মার্ট। তবে নুসাইবার মতে আফসানা যতটা না সুন্দরী তার থেকে বেশি মেইনটেইন করে। নুসাইবার মতে সরকারি অফিসেও সুন্দরী মেয়ে কম নেই তবে সরকারি অফিসে ছেলে বা মেয়ে কেউ ড্রেসাপে অতটা জোর দেয় না। সেই জায়গায় কর্পোরেটের লোকজন ড্রেসাপ এন্ড গেটাপে যে পরিমাণ জোর দেয় তাতে নরমাল সুন্দরী মেয়েও অনেক সুন্দরী হয়ে উঠে। তবে আফসানার গেটাপে একটা চটকদার ব্যাপার আছে। ঠিক স্লাটি টাইপ কিছু না বাট দেখলে আরেকবার দেখার ইচ্ছা হবে এমন। আফসানার সাথে অন্যরা যে অহরহ ফ্লার্টিং করার চেষ্টা করে সেটা নুসাইবার চোখ এড়ায় নি। তবে আফসানা কে শুধু যে এই কারণে আজকে দাওয়াতে চয়েজ করেছে সেটা না। নুসাইবা আফসানার সাথে কথায় কথায় জেনেছে আফসানা মফস্বল থেকে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ এমবিএ করে এখন ব্যাংকে চাকরি করে। বাবা কলেজে টিচার মফস্বলে আর মা গৃহীনি। নুসাইবার মতে মাহফুজের সাথে ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডের দিক থেকে আফসানাই যায় বেশি। আর যদিও সিনথিয়ার সাথে মাহফুজের বিয়ে হোক তা নুসাইবা চায় না তবু মাহফুজ যে দেখতে সুদর্শন এবং স্মার্ট সেব্যাপারে নুসাইবার আপাতত কোন ডাউট নেই। সেটাই আজকের প্ল্যানের অন্যতম মূল দিক। নুসাইবা আশা করছে আজকে মাহফুজ এবং আফসানা দুইজনেই দুইজনের প্রতি একটু হলেও আকৃষ্ট হবে। আফাসানা যে রকম পাত্র খুজছে বলছে মাহফুজ তার জন্য পারফেক্ট। ফিনিন্সাসিয়ালি সলভেন্ট, ভবিষ্যতের প্রসপেক্ট ভাল এবং ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড খুব হাইফাই না। আফসানা বলেছে খুব হাইফাই ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডের ছেলে কে বিয়ে করলে পরে ওর সিম্পল ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য কথা শুনতে হতে পারে। সেটা সে চায় না। তাই আফসানার মাহফুজ কে পছন্দ হবে এটা নুসাইবা আশা করছে। এবার মাহফুজ কি করবে সেটাই বিষয়।

মাহফুজ সম্পর্কে নুসাইবা আজকাল একটু সংশয়ে থাকছে। এমনিতে মাহফুজ কে অপছন্দ করার মত কিছু নেই। তবে যখন থেকে নুসাইবা সন্দেহ করছে মাহফুজ আর সিনথিয়ার মধ্যে কিছু একটা আছে এবং সিনথিয়া ইজ সিরিয়াস এবাউট দিস রিলেশন। তখন থেকেই মাহফুজ কে ঠিক ভাল নজরে দেখতে পারছে না। আর জেবা আর রিয়াদ ভাইয়ের ছেলের এডমিশন করিয়ে দেবার পর থেকেই মাহফুজের নাম ওর শরীরের একটা সুক্ষ জ্বলুনি তৈরি করছে। নুসাইবা ওর ইমোশন সহজে লুকাতে পারে না। অনেক সময় ঠিক করে না ভেবে ইমোশনের উপর ডিসিশান নেয়। তাই আরশাদ যখন ওকে বুঝাচ্ছিল মাহফুজ সম্পর্কে সহজে কোন সিদ্ধান্ত না নিতে এবং হুট করে এই ব্যাপারে কিছু না করতে তখন মেনে নিতে না পারলেও আরশাদের কথা ফেলে দিতে পারছিল না। আসলেই তো মাহফুজের অযোগ্যতা কোথায়? যে কোন বিচারে মাহফুজ যথেষ্ট ভাল পাত্র। ওদের ফ্যামিলিতে কেউ কখনো রাজনীতি করা ছেলে বিয়ে করে নি। তবে এটাও ঠিক মাহফুজ রাস্তার গুন্ডা বদমাশ বা পাড়ার টোকাই পলেটিশিয়ান না। সামনে ওর ভাল প্রসপেক্ট আছে রাজনীতিতে। তার উপর আরশাদের কথা অনুযায়ী ব্যবসায় ভাল সম্ভাবনা আছে। আর কাজে কেমন দক্ষ সেটা তো পিকনিকের সময় নুসাইবা দেখল। কিন্তু এত কিছুর পরেও মাহফুজ কে ঠিক ওদের বাড়ির জামাই হিসেবে মেনে নিতে পারছে না। এমন না যে মাহফুজ খারাপ কিছু করেছে। তবু নুসাইবার মনে হয় মাহফুজের ব্যাকগ্রাউন্ড আফসানার জন্য ঠিক আছে। দুইজনেই এম্বিশাস, দুই জনেই হাম্বল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছে। তাই ওদের মিল হওয়া ভাল। নুসাইবা নিজে কে নিজেই বুঝ দেয় এতে খারাপ হবার কিছু নেই। কারণ বিয়ে নিয়ে নুসাইবার কিছু ব্যক্তিগত মতামত আছে। তার একটা হল স্বামী স্ত্রীর ব্যাকগ্রাউন্ড যত কাছাকাছি হবে বিয়ে তত সুখের হবে। প্রেমের কারণে খালি বিয়ে করলে বিয়ে সুখী হবে সেটা না। ওর আর আরশাদের পনের বছরের সুখের সংসারের প্রধান কারণ নুসাইবা মনে করে ওদের সিমিলার ব্যাকগ্রাউন্ড। তাই নুসাইবা মনে মনে ভাবে ও যা করছে এটা খালি সিনথিয়ার জন্য নয় বরং মাহফুজের জন্যও ভাল হবে।

সকাল থেকে নুসাইবা রান্না বান্নায় ব্যস্ত। আজকে কাজের লোক কে ফোন দিয়ে তাড়াতাড়ি নিয়ে এসেছে। অন্যদিন বেলা এগারটা বাজার আগে আসে না কাজের লোক। আরশাদ রান্না ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। রান্না ঘরে যদিও এগজস্টিং ফ্যান চলছে তবু রান্নার কারণে ভীষণ গরম। রীতিমত ঘামছে নুসাইবা। নুসাইবা রান্না বান্নায় হাত ভাল। বাসায় পরে থাকা সালোয়ার কামিজটা ঘামে শরীরের সাথে লেগে আছে। নুসাইবার শরীর এই ঘামে ভেজা কাপড়ে একদম ফুটে উঠেছে। এত বছর পরেও নুসাইবার শরীরের চমক কমে নি বরং বেড়েছে। নুসাইবা কে পিছন থেকে দেখতে দেখতে আরশাদের মনে হয় নুসাইবার মত এমন বউ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। নুসাইবার মেজাজ একটু গরম, মাঝে মাঝে ডমিনেটিং। তার পরেও এর থেকে ভাল পাওয়া সম্ভব ছিল না। এমন সুন্দরী কাউকে বিয়ে করবে সেটাও ভাবে নি কম বয়সে। যখন নুসাইবা কে বিয়ে করেছিল তখন হিসাব করলে নুসাইবা ছিল ওর বন্ধুর বউদের মধ্যে অন্যতম সুন্দরী। কিন্তু সময়ের সাথে নুসাইবার সৌন্দর্য যেন বাড়ছে। অনায়েসে এখন আরশাদ বলতে পারে ওর বন্ধুদের মধ্যে নুসাইবা এখন প্রথম সুন্দরী ওয়াইফ। পুরান মদের মত সময়ের সাথে সাথে নুসাইবার মাদকতা খালি বাড়ছে। নুসাইবা কে মাঝে মাঝে আড়াল থেকে লক্ষ্য করে আরশাদ। আর প্রতিবার এইভাবে লক্ষ্য করার সময় নুসাইবা নিয়ে ওর চিন্তা গুলো উকি দেয়। মনের মধ্যে একটা পাপবোধ জেগে উঠে। নুসাইবা ওকে যেরকম ভালবাসে তাতে কখনোই নুসাইবা কে ওর মনের কথা বলা যাবে না। রেগে পাগল হয়ে যাবে। আর নুসাইবার ভালবাসা ছাড়া আরশাদ থাকতেও পারবে না। নুসাইবার জন্য ও মরিয়া। তাই শুধু শুধু ওর মনের ভিতরের চিন্তা গুলো নুসাইবা কে বলে রিস্ক নিতে চায় না। এর বাইরেও আরেকটা অপরাধবোধ আরশাদের মধ্যে সব সময় থাকে। এটা আর বড় অপরাধবোধ। ওদের কোন সন্তান নেই। নুসাইবার মত একটা মেয়ে যে বাচ্চাদের এত ভালবাসে তার উচিত ছিল অন্তত একটা সন্তান পাওয়া। এটা নিয়ে ভাবতে আর ভাল লাগে না। কিছু জিনিস মনের ভিতর চাপা পড়ে থাকা ভাল। নাহলে অপরাধবোধে পাগল হয়ে যাবে, মাঝে মাঝে ভাবে আরশাদ।

নুসাইবা টের পায় আরশাদ রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝেই এমন করে নুসাইবা যখন কাজ করে তখন দূর থেকে আরশাদ তাকিয়ে তাকিয়ে ওকে দেখে। নুসাইবা আড় চোখে কাজের বুয়ার দিকে তাকায়। মাছ কাটতে কাটতে বাসার স্যার ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসে বুয়া। নুসাইবা দেখে বুয়ার হাসি। একটু লজ্জা লাগে। তবে ভাল লাগে এইভাবে বিয়ের এত বছর পরেও ওর স্বামী এখনো লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে দেখে। ওর বান্ধবীরা দেখা হলেই গল্পের সময় স্বামীদের নামে অভিযোগের বন্যা বইয়ে দেয়। ঠিকমত মনযোগ দেয় না, কেউ অন্য জায়গায় প্রেম করে বেড়ায়। কিন্তু নুসাইবার বিশ্বাস ওর আরশাদ এর বাইরে। এই রকম আড়াল থেকে দেখা মূহুর্ত গুলো নুসাইবার বিশ্বাসের ভিত্ত শক্ত করে। মাঝে বছর দুই তিন আগে একবার যখন ওদের বাচ্চা না হওয়া নিয়ে ওর শ্বশুড় বাড়িতে কথা উঠল তখন আরশাদ যেভাবে বলেছিল, এই ব্যাপারে কেউ আর যেন কখনো একটা কথা না বলে এবং নুসাইবা কে যেন আর কিছু এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস না করে, ঠিক তখন থেকে নুসাইবা যেন আবার নতুন করে আরশাদের প্রেমে পড়েছে। নুসাইবা আরশাদ কে জিজ্ঞেস করে কিছু বলবে? আরশাদ নুসাইবার প্রশ্ন শুনে পৃথিবীতে ফিরে আসে। ওর চিন্তা গুলো দ্রুত মনের ভিতর লুকিয়ে রাখতে চায়। যেন নুসাইবা দৃষ্টি দেখে পড়ে ফেলবে ভিতরের সব চিন্তা। আরশাদ তাই কথা ঘুরানোর জন্য বলে, একদম জামাই আদরের জন্য রান্না করছ দেখি। নুসাইবা হেসে ফেলে। আসলেই আজকে বহু কিছু রান্না করে ফেলছে। মুরগী, খাসি, মাছ, পোলাও, পায়েস। নুসাইবা বলে আরে আমাদের প্ল্যান সফল হতে গেলে আফসানা আর মাহফুজ দুইজনের মন খুশি খুশি থাকতে হবে। ভাল খাওয়া সবার মন খুশি রাখে। আরশাদ বলে তুমি আফসানা কে দাওয়াত দিচ্ছ মাহফুজের সাথে এটা জানলে সিনথিয়া কি বলবে ভেবেছ কিছু। নুসাইবা বলে আরে আমি বলব দুইজন আমাদের উপকার করেছে তাই দুইজন কে দাওয়াত করেছি। এর মাঝে আর কিছু নেই। আরশাদ বলল হ্যা সিনথিয়া মানলেই হয়। নুসাইবা বলে সিনথিয়ার চিন্তা পরে করো। আজকে আমাদের চিন্তা মাহফুজ কে আফসানার সাথে একটু হুকাপ করিয়ে দেওয়া। এরপর দেখবে হাওয়া নিজে থেকেই চলবে। আরশাদ বলে এত সিওর হয়ো না। সিনথিয়া কলেজ থেকেই প্রেম করে সেটা তুমি জান। কিন্তু আর কখনো কোন প্রেমের ব্যাপারে সিরিয়াস সেটা মনে হয় নি। কিন্তু এই ব্যাপারে ও সিরিয়াস। আর মাহফুজকেও মনে হল ভাল কমিটেড। তার উপর মাহফুজ ভাল চালাক ছেলে। বেশি কিছু বলতে যেও না, মাহফুজ তাহলে সহজেই তোমার প্ল্যান ধরে ফেলবে। নুসাইবাও মনে মনে এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তিত। মাহফুজ কে সরাসরি বা ইংগিতে আফসার দিকে ঠেলে দেওয়া যাবে না। মাহফুজ যথেষ্ট চালাক ছেলে। বুঝতে পারলে কাজ হবে না প্ল্যানে। নুসাইবা বলে কিছুই যদি না বলি তাহলে মাহফুজ আর আফসানায় বিক্রিয়া ঘটবে কিভাবে। আরশাদ বলে আপাতত এটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দাও। বেশি কিছু বলতে গেলে বিক্রিয়া তো হবেই না বরং আর উলটো রেজাল্ট আসবে। আর মাহফুজ ছেলে অত খারাপ না যদিও তুমি ওকে চাও না। আমার কিন্তু মাহফুজের ব্যাপারে অত না নেই। নুসাইবা একটু ঝাঝের সাথে বলে তোমরা ছেলে মানুষরা এত কিছু বুঝবে না। বিয়ে একটা বড় ব্যাপার। এখানে খালি প্রেম না আর অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে হয়। আমি খালি সিনথিয়ার জন্য না মাহফুজের ভালর জন্য এই কাজ করছি। আর দেখ আমাদের দুইজনের কোন সন্তান নেই। ডাক্তার বলেছে আমি মা হতে পারব না। এটা জানার পরেও তুমি যেভাবে আমাকে সাপোর্ট দিয়েছ সেটা আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ডের মিলের কারণেই হয়েছে। নুসাইবার কথা শুন আরশাদ অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। পুরাতন পাপবোধ যেন বুকের ভিতর পাথর হয়ে বসতে থাকে। আরশাদ তাই কথা এড়িয়ে বলে, তাড়াতাড়ি রান্না কর। এরপর গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিতে হবে। ওরা চলে আসবে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই।​
Next page: Update 33
Previous page: Update 31