Update 49

আপডেট ২৭



নুসাইবার সারা রাত প্রচন্ড জ্বরে কাটল। এই জ্বরের মধ্যে ড্রয়িংরুমের বমি পরিষ্কার করল। ওর মনে হচ্ছে এই বমি যেন সাক্ষাত মুন্সীর চিহ্ন বহন করছে। যতক্ষণ না ধুয়ে মুছে বমির চিহ্ন শেষ করছে ততক্ষণ মুন্সীর চিহ্ন ঘর থেকে যাচ্ছে না। জ্বর আর পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে শেষরাতের দিকে প্যারাসিটিমল আর ঘুমের ঔষুধ খেয়ে ঘুম দিল। ঘুম ভাংগল বেরা বারটায়। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে অসংখ্য মিসকল। অফিস থেকে কিছু মিসকল, কয়েকটা ম্যানেজারের ফোন থেকে আর কয়েকটা ম্যানেজারের যে ছেলেটা সকালে ওর সাথে অফিসে যায় তার মোবাইল থেকে। আর একটকা ফোন নাম্বার অচেনা। দরজায় প্রচন্ড জোরে নকের শব্দ। শরীরটা কোন রকমে টানতে টানতে দরজার কাছে নিয়ে গেল। পিপহোল দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখতে পেল ম্যানেজারের ছেলেটা। দরজা খুলতেই ছেলেটা বলল ম্যাডাম সব ঠিক আছে? নুসাইবা একবার ভাবল মুন্সীর কথা বলবে কিনা। তবে পরক্ষণেই ভাবল মুন্সীর কথা কি বলবে আসলে? মুন্সী যা করেছে সেটা কি আসলে বলা যায় অন্য কাউকে? নুসাইবা বলল জ্বর আসছে তাই আজকে একটু বেলা করে উঠছি। অফিসে যাব না আজকে। ছেলেটা বলে ওকে ম্যাডাম, আমরা আবার ভয়ে ছিলাম। আপনার কিছু দরকার হলে বলবেন। যদি ডাক্তার লাগে বলবেন। ছেলেটার সাথে আর কিছু কথা বলে দরজা লাগিয়ে দিল।

দরজা লাগিয়ে ভিতরে আসতে না আসতেই আবার ফোন বেজে উঠল। অচেনা ফোন নাম্বারটা। রিসিভ করতেই ঐপাশ থেকে পরিচিত গলা কেমন আছেন ম্যাডাম? আজকে অফিসে যাবেন না? কালকে বেশি করে ফেললাম নাকি? এই বলেই খিক খিক করে একটা হাসি। নুসাইবার মনে হয় যেন আবার জ্বর এসে যাবে এই গলার স্বর শুনলে। নুসাইবা বলে আপনি? মুন্সি বলে কেন ম্যাডাম আর কে ফোন করার কথা ছিল? আরশাদ সাহেব? একটু তাড়াতাড়ি করেন তো, উনার সাথে আমার একটা কথা বলার ব্যবস্থা করে দেন। নুসাইবা বলে বিশ্বাস করেন আমার সাথে আরশাদের কোন কথা হয় না কিছুদিন। মুন্সী বলে আরে সেইটা বিশ্বাস করছি বলেই তো গতকাল অল্পতে চলে আসছি নাহলে এমন মজা কি সহজে ছাড়া যায় বলেন ম্যাডাম। আপনি ছাড়তে পারতেন এমন একটা সুযোগ। মুন্সীর কথা নুসাইবার শরীরে একটা ঘিন্না ছড়ায়। মুন্সী বলে ম্যানেজারের ছেলেটা আপনাকে কি বলল ম্যাডাম? নুসাইবা চমকে যায়, বলে আপনি কিভাবে জানলেন। মুন্সি বলে জানতে হয় ম্যাডাম। এটাই আমার বিজনেস। এইটা না জানলে কি কালকে রাতে আপনার বাসা পর্যন্ত আসতে পারতাম। আপনার বিল্ডিং এর গেট কেউ পার হলেই আমার কাছে খবর চলে আসে। এইটুকু যদি করতে না পারতাম তাহলে ম্যানেজারের মত রাঘব বোয়ালের হাতের তলা দিয়ে আপনার কাছে আসার সাহস পেতাম? বলেন? ম্যানেজারের ছেলেটা আমার কথা বলছেন ম্যাডাম। নুসাইবা মৃদু স্বরে বলে না। মুন্সী খিক খিক করে হেসে উঠে। বলে আপনি বুদ্ধিমান আমি জানতাম। আমাদের এইসব কথা কি সবাই কে বলা যায় বলেন। আর ম্যানেজার যে রাগী লোক দেখা গেল আপনার মাথায় একটা গুলি ঠুকে দিল। আর সব এমন ভাবে সাজাবে যে পরের দিন পত্রিকায় রিপোর্ট আসবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিডির আত্মহত্যা। আমি আবার সহজে এইসব খুন খারাপিতে যাই না। আর আপনার মত একটা সরেস মহিলা কে মেরে ফেললে আনন্দ কই বলেন। আপনি বেচে থাকলে তো আমার লাভ কি বলেন? গতকাল রাতের কথা চিন্তা করেন। আপনি কিছু না কইরাই যে আনন্দ দিছেন সেইটা তো অন্য কেউ কাপড় খুললেও দিতে পারত না। মুন্সীর কথার ইংগিতে নুসাইবার গা ঘিন ঘিন করে। মুন্সী বলে যাই হোক মনে রাইখেন কিন্তু। ম্যানেজাররে বললে পরে ম্যানেজার কি করবে কেউ জানে না। আপনি খালি আমারে আরশাদ সাহেবের সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেন। নাইলে উনার ফাইলপত্র যোগাড় করে দেন। বাকিটা আমি দেখব। মনে রাখবেন আমারে বেশিদিন অপেক্ষায় রাখলে কিন্তু আমার আবার আপনার সাথে দেখা করতে হবে এই বলে হাসতে থাকে। অবশ্য সেটা খারাপ না। আপনার সাথে এক একটা অভিজ্ঞতা এক কোটি টাকার থেকে দামী। এই বলে আবার হাসতে থাকে। নুসাইবার গা গুলিয়ে উঠে। মুন্সী বলে যা করার তাড়াতাড়ি করেন ম্যাডাম। এই বলে ফোন রেখে দেয়।
নুসাইবা মনে মনে আয়াতুল কুরসী পড়তে থাকে। ভয় পেলে সব সময় এই দোয়া পড়ে ছোট কাল থেকে। এখন কিছু করতে হবে ওর মনে হয়। এইভাবে চুপচাপ থাকলে মুন্সী নাহলে ম্যানেজারের হাতে মরতে হবে। মুন্সীর হাত আরেকবার শরীরে পড়ার চাইতে অবশ্য ম্যানেজারের গুলি খাওয়া ভাল। নুসাইবার মনে হয় এই মূহুর্তে কার কাছে যাবার উপায় ওর নেই। যার কার কাছে যাবার উপায় নেই তার নিজের উপর ভরসা রাখতে হয়। এই কথাটা মাথায় আসতেই যেন একটা শক্তি পায় নিজের মধ্যে। যেভাবেই হোক এখান থেকে বের হতে হবে। আর এই মূহুর্তে ওর নিজের উপর ছাড়া আর কার উপর ভরসা করার মত উপায় নেই। তবে ওর সাহায্য লাগবে কার না কার। মাহফুজ ছাড়া আর কার নাম মাথায় আসছে না। ওর আত্মীয় স্বজন কাউকে এইসব জড়ানোর ইচ্ছা নেই আর জড়ালেও কেউ তেমন হেল্প করতে পারবে না। আরশাদের বন্ধু মিজান হেল্প করতে পারত হয়ত কিন্তু মিজান যেভাবে ম্যানেজারের কজ্বায় তাতে মন হয় না ওর কোন সাহায্যে আসবে। আর বাকি থাকে মাহফুজ। মাহফুজের কথা ভাবতেই ফ্লোরার দোকানের ঘটনা মনে পড়ে যায়। আবার মুন্সীর কুৎসিত হাসি ভাবে তখন মনে হয় মাহফুজের সাহায্য ওর দরকার। তবে সব কিছু এমনভাবে করতে হবে যাতে কেউ সন্দেহ না করে। ম্যানেজার বা মুন্সী কেউ না। আজকে মুন্সীর কথায় টের পেয়েছে ম্যানেজারের সাথে সাথে মুন্সীও ওর উপর নজর রাখছে। মুন্সী কতটা ডেঞ্জারাস সেটা টের পেয়েছে। মুন্সী যেভাবে বলল বিল্ডিং এর গেট পার হলেই তার কাছে খবর যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে গেটের সিকিউরিটি কে হাত করেছে নাকি। গতকাল রাতেই কথাটা মনে আসছিল ওর। কেন সিকিউরিটি একজন ফুড ডেলিভারি ম্যান এতক্ষণ উপরে আছে সেটা খবর নিতে আসে নি। এখন মুন্সীর কথায় মনে হচ্ছে সিকিউরিটি কম্প্রমাইজড। অফিসেও ওর উপর ম্যানেজার আর মুন্সী নজর রাখছে। কিন্তু কিভাবে সেটা সিওর না ও।

এইসব ভাবতে ভাবতে ওর চোয়াল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। এইভাবে বাচতে পারে না। বের হতে হবে এর থেকে। গত কয়েক মাস সব যেন ওর হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে। আরশাদ, ম্যানেজার, মাহফুজ, মুন্সী সবাই যেন ওর জীবন নিয়ে খেলছে। এর থেকে ওর বের হতে হবে। দরকার হলে মাহফুজের সাহায্য নিতে হলে নিবে। কিন্তু ওর নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে নিজের জীবনের। প্রিয় একটা লাইন তাই নিজে নিজে বলে- মাস্টার অফ মাই ফেট, ক্যাপ্টেন অফ মাই সোল। আর কার হাতে জীবনের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়া যাবে না। মাস্টার অফ মাই ফেট, ক্যাপ্টেন অফ মাই সোল।



সাফিনা বসে ওয়েট করছে। একটা ওয়েটিং রুমের মত জায়গা। গত কয়েক মাস ধরে মাসের জোড় সাপ্তাহের মংগলবার এখানে আসেন সাফিনা করিম। দেড় ঘন্টার সেশন হয়। ঢাকার উঠতি বড় সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলরদের একজন আদিবা রহমান। ঢাকায় সবাই সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলর বলতে ****** কে বুঝায়। উনার কাছে শিডিউল পাওয়া কঠিন। তাই আরেকটু খোজ করে আদিবা রহমানের খোজ পেয়েছেন। অপেক্ষাকৃত তরুণ। বয়স ৪০ এর আশেপাশে হবে। ওয়েটিং রুমে লাগানো বড় বোর্ডের নিচে ডিগ্রির লিস্ট দেখে বুঝা যায় মেধাবী। ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস। এরপর সাইকোলজিতে একটা ডিগ্রি। এরপর ইংল্যান্ড থেকে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির উপর মাস্টার্স। সাফিনা বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে যখন খোজ করেছিলেন তখন সবাই ***** এর কথা বলেছিল। এর বাইরে যাদের নাম খুজে পেয়েছিলেন সবাই পুরুষ। মনের কথা গুলো শেয়ার করবার জন্য একজন পুরুষ সাইকোলজিস্ট এর কাছে অস্বস্তি হত তাই সেখানে আর যান নি। এরপর নুসাইবা কে একদিন বলেছিলেন। আসলে নুসাইবার সাথে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে সেটা ননদ ভাবীর সম্পর্ক কে ছাপিয়ে গেছে। নুসাইবা যেমন তার জীবনের অনেক গোপন কথা শেয়ার করে ঠিক তেমনি উনিও শেয়ার করেন। নুসাইবা তখন বলেছিল ওর এক বান্ধবী ডিপ্রেশনে ভুগছে। সে ***** এর কাছে নিয়মিত শিডিউল না পেয়ে কয়েক জন সাইকোলজিস্ট এর কাছে ঘুরে শেষ পর্যন্ত আদিবা রহমানের কাছে থিতু হয়েছে। ভদ্রমহিলা নাকি খুব মনযোগ দিয়ে কথা শুনেন। ইন্টারেপ্ট করেন না। অনেক সাইকোলজিস্ট যেমন অল্প একটু শুনে পেসেন্ট এর জন্য ব্যবস্থাপত্র তৈরি করে ফেলেন ইনি তেমন না। তাই নুসাইবার সাজেশনেই আদিবা রহমানের কাছে আসছেন গত দুই মাস ধরে। বেশ ভাল লাগছে। প্রথম প্রথম অস্বস্তি হত। এরকম অপরিচিত একটা লোকের কাছে নিজের জীবনের নানা কথা আলোচনা করতে। নিজের ক্ষোভ, রাগ, দুঃখ, হাহাকার, অপূর্ণতা, সুখ, আশা, পরিকল্পনা সব। এখন আস্তে আস্তে প্রাথমিক অস্বস্তি ভেংগে গেছে। মন খুলে কথা বলতে পারার একটা আনন্দ আছে। কোন জাজমেন্ট নেই, পরবর্তীতে এই কথা নিয়ে কেউ কিছু ভাববে কিনা সেটা ভাবার দরকার নেই।

সাইকোলজিস্ট এর কাছে আসার বুদ্ধি অবশ্য প্রথমে আতিয়া আপা দিয়েছিলেন। আতিয়া আপা কলেজে সাফিনার সহকর্মী। বয়স ৫০ এর উপরে। বেশ কয়েকটা কলেজে একসাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে দুইজনের। তাই একটা ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সাফিনা নিজে টের পাচ্ছিল যে ওর আজকাল মন মেজাজ ভাল থাকে না প্রায় সময়। মেজাজ তীরিক্ষে থাকে। স্বামী মিজবাহ করিমের উপর দিয়ে মাঝে মধ্যে এর ঝাল যায় টের পান। পরে মেজাজ ঠান্ডা হলে মনে হয় এত রাগারাগী না করলেও পারত। আগে যে সব জিনিসে গা করত না আজকাল সেই সব জিনিসে মেজাজ গরম হয়। আবার মাঝে মাঝে অকারণে মন খারাপ হয়। যেন আবার সেই কিশোরী বেলায় ফিরে গেছেন। যখন মন খারাপ হবার জন্য কোন কারণ লাগত না। মাঝে মাঝে এই অকারণ মন খারাপ এমন বড় হয়ে দেখা দেয় যে আর কোন কাজ করতে ইচ্ছা হয় না। ক্লাস নিতে ইচ্ছা হয় না, বাসায় কোন কাজ করতে ইচ্ছা হয় না, ঘুরতে যেতে ইচ্ছা হয় না। মাঝ বয়সী একজন মহিলার জন্য এইসব বাংলাদেশে আদিখ্যেতা। তাই কাউকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যান নি। মিজবাহ এত ব্যস্ত থাকে যে বউয়ের এই মন খারাপ খুব একটা চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না। অথবা চোখে পড়লেও কিছু বলে নি। মিজবাহ অনেক সময় এমন করে। সরাসরি কনফ্রনটেশনে যেতে চায় না। তাই অপেক্ষা করে সাফিনা যতক্ষণ না কিছু বলে। অন্তত গত ছাব্বিশ বছর ধরে এই ফরমুলা ভাল কাজ করেছে। আজকাল অবশ্য সাফিনার মন খারাপ হয়। লোকটা কি ওর মন খারাপ বুঝতে পারে না। পারলে কিছু বলে না কেন। নুসাইবার অবশ্য চোখে পড়েছিল। কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেও এড়িয়ে গেছে সাফিনা। সারাজীবন নুসাইবা কে উপদেশ দিয়ে এসেছে। এখন নিজের এমন মুড সুইং এর আদিখ্যেতা নিয়ে নুসাইবার সাথে কথা বলতে লজ্জা হচ্ছিল। পরে একদিন আতিয়া আপা কলেজের টিচার্স ক্লাবে সাফিনা কে চেপে ধরলেন। আতিয়া আপার মধ্যে একটা মাতৃত্বসুলভ ব্যাপার আছে। গলায় যে স্নেহ মাখা স্বরে কথা বলেন তার পরশ যেন বুকে লাগে। আতিয়া আপার সাথে কথা বলার সময় সাফিনা যেন প্রথমবারের মত নিজের বাইরে কার কাছে নিজের অনুভূতি গুলো তুলে ধরল। নিজেও জানে না ওর হঠাত এই অনুভূতির কারণ কি। সাবরিনা বিয়ের পর থেকে নিজের বাসায় থাকে। সিনথিয়া ছিল বাসার প্রাণ। জমিয়ে রাখত বাসাটা। আজকাল সিনথিয়া বিদেশে পড়তে যাবার পর থেকে বাসাটা যেন একদম খালি পড়ে থাকে। সেই থেকে যেন বুকের ভিতর শূণ্যতার শুরু। মন খারাপ সাইকেল তখন থেকে শুরু হয়েছে। আতিয়া আপা মনযোগ দিয়ে সব শুনলেন।

আতিয়া আপা সব শুনে বললেন দেখ সাফিনা তুমি যে মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেটা নতুন কিছু না। প্রায় সব মানুষ এর মধ্যে দিয়ে যায় জীবনের একটা না একটা সময়। ছেলেদের এই সমস্যার একটা সুন্দর নাম আছে। মিড লাইফ ক্রাইসিস। আমারা মেয়েরাও যে এই সমস্যার ভিতর দিয়ে যাই সেটা কিন্তু খুব একটা শুনবে না কারণ মেয়েরা সহজে নিজেদের কথা প্রকাশ করে না। আর মানসিক অস্থিরতার কথা বললে লোকে পাগল ভাববে তাই আর গোপন করে মেয়েরা। তবে সবাই যায় কমবেশি এই অবস্থার মধ্য দিয়ে। আমিও গিয়েছি। মধ্য বয়স এমন একটা সময় যখন সব মানুষ তার চাওয়া পাওয়ার হিসাব মিলায়। খুব কম মানুষ জীবনে তার সব লক্ষ্য পূরণ করতে পারে। এই বয়সে মানুষ বুঝতে পারে তার জীবনের অনেক লক্ষ্য পূরণ হবে না। আবার পরিবারের ডায়নামিক্সেও একটা পরিবর্তন আসে। দেখ তোমার এক মেয়ে বিয়ে করে আলাদা থাকে। আরেক মেয়ে বিদেশে পড়তে গেছে। ফলে গত প্রায় পচিশ ছাব্বিশ বছরের মধ্যে এই প্রথম তুমি সন্তান ছাড়া একা থাকছ। সন্তানদের প্রতি দ্বায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মায়েদের জীবনে যে একটা রুটিন তৈরি হয় সেই রুটিন থেকে তুমি মুক্ত। তবে এই নতুন পাওয়া সময় কে কিভাবে ইউজ করতে হবে বেশির ভাগ সময় আমরা সেটা জানি না। আমার সন্তান দূরে যাওয়ায় যে হাহাকার সেটাকেও মোকাবেলা করা কঠিন। তোমার স্বামী আর বেশি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে আগের মত সময় দিতে পারছে না। এই ব্যাপারটা আগে অত তোমার চোখে পড়ত না কারণ তখন তোমার মেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হত। এখন সেই ব্যাপারটা নেই। সব মিলিয়ে তোমার জীবনের যে শূণ্যতা তৈরি হয়েছে সেটা নিয়ে তোমার মনে একটা বিষাদ তৈরি হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। তার উপর এই বয়সটা মেয়েদের জন্য গূরুত্বপূর্ণ। এই মধ্য চল্লিশে মেয়েদের শরীরে আবার হরমোনাল পরিবর্তন গুলো শুরু হয়। সেটাও একটা কারণ হতে পারে। সব মিলিয়ে তোমার আসলে একটা প্রপার ডায়াগনসিস দরকার। আমার মনে হয় তুমি খানিকটা ডিপ্রেসড। আমাদের সমাজে কেউ ডিপ্রেশন কে ভাল ভাবে নেয় না। হাসি ঠাট্টার ব্যাপার মনে করে। ভাবে বড়লোকের অসুখ। তবে তুমি হেলাফেলা করো না। একজন সাইকোলজিস্ট কার কাছে যাও। দরকার হলে কাউন্সিলিং করতে পার। আতিয়া আপার সাথে কথার পর সাফিনা প্রথমবারের মত সিরিয়াসলি সাইকোলজিস্ট এর হেল্প এর কথা ভেবেছে। পরে নুসাইবার হেল্পে এই এখানে কাউন্সিলিং এ আসছে।

আজকে যে সময়ে কাউন্সিলিং তার প্রায় এক ঘন্টা আগে থেকে এখানে চলে এসেছে। এসে গত দশ মিনিট ধরে ওয়েট করছে। আগে আসার একটা কারণ আছে। নুসাইবা আজকে দুপুরে ফোন করে বলেছে যে ভাবী তোমার আজকে প্রোগ্রাম কি। নুসাইবা ছাড়া ফ্যামিলির আর কেউ জানে না সাফিনা কাউন্সিলিং করে। তাই নুসাইবার কাছে লুকানোর কিছু নেই। সাফিনা বলল বিকাল চারটার দিকে ওর কাউন্সিলিং এর সেশন আছে। নুসাইবা কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলল তুমি কি এক ঘন্টা আগে ঐখানে যেতে পারবা? তোমার সাথে একটু কথা ছিল। এমন একটা জায়গায় কথা বলতে চাওয়ায় অবাক হল সাফিনা। বলল তোর কোন দরকার থাকলে বল, আজকে কাউন্সিলিং সেশন বাদ দিয়ে তোর কাছে যাই অথবা তুই আমাদের বাসায় আয়। নুসাইবা জোর করে। আর কোথাও না। ঐখানেই দেখা করবে। আর যেন কাউকে ওর সাথে দেখা হবার কথা না বলে। কিছুদিন আগে আরশাদের সম্পর্কে কিছু কথা জানানোর পর থেকে নুসাইবার আচরণে খানিকটা পরিবর্তন এসেছে। অন্যমনস্ক থাকে, কিছুটা সিক্রেটিভ। সাফিনা ভেবে বলে ওকে, তুই যদি চাস তাহলে যাচ্ছি আজকে এক ঘন্টা আগে। এমনিতেও আজকে আমার ক্লাস সকাল সকাল শেষ। আর কিছু নেই। সেই জন্য গত দশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছে সাফিনা।



যে ভাবে হোক মুন্সি আর ম্যানেজারের খপ্পর থেকে বের হতে হবে এটা ঠিক করার পর থেকে নুসাইবার মনে একটা জোর এসেছে। আরশাদের খবর গুলো শোনার পর থেকে হেল্পলেস মনে হচ্ছিল গত কয়েক মাস। গত দুই মাসে এই প্রথমবারের মত সেই হেল্পলেস ভাবের জায়গায় মনে হচ্ছে নিজে কে কিছু করতে হবে। মাথায় নির্দিষ্ট কোন প্ল্যান নেই। তবে বুঝতে পারছে একা সব কিছু করতে পারবে না। তবে আর কাউকে বিপদে জড়াতে চাইছে না। মাহফুজ কে দরকার হবে বুঝতে পারছে। তবে কিভাবে সেটা শিওউর না। যাই করুক টাকার দরকার। তবে নিজের একাউন্ট থেকে টাকা তুলতে চাইছে না। মুন্সী আর ম্যানেজারের হাত কত গভীরে তা শিওউর না। নিজের একাউন্ট থেকে টাকা তুললে সেটা ওরা যদি কোন ভাবে টের পায় তাহলে বুঝবে ও কিছু একটা করতে যাচ্ছে। তখন সাফিনা ভাবীর কথা মাথায় এসেছে। ম্যানেজারের লোক ওকে ফলো করে, মুন্সীর লোকও ফলো করে শিওর। তাই এমন একটা জায়গা দরকার যেটাতে কেউ সন্দেহ করবে না। ভাবী প্রতি মংগলবার কাউন্সিলিং এ যায়। এটা ভাবতে ভাবতে প্রথম বুদ্ধিটা মাথায় আসে। ভাবীর সাথে ঐখানে দেখা করতে হবে। ম্যানেজারের লোকেরা কিছু জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে কাউন্সিলিং এ যাচ্ছে। আর দরকার হলে ঐখানে গিয়ে একটা ফেক শিডিউল নিতে হবে পরের সাপ্তাহের জন্য। যাতে কেউ পরে ঐখানে গিয়ে খোজ করলে সন্দেহ না করে। তাই প্রথম কাজটা করে সাফিনা কে ফোন দিয়ে একটু আগে যেতে বলে কাউন্সিলিং এ।
সাফিনা, নুসাইবা কে দেখে চমকে উঠে। চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে ঝড় বয়ে গেছে। সাফিনা ওয়েটিং রুমের চেয়ার থেকে উঠে দাড়াতে যায় নুসাইবা চোখের ইশারায় না করে। সাফিনা বসে পড়ে। নুসাইবার পিছন পিছন একটা ছেলে ঢুকে। নুসাইবা কাউন্টারে গিয়ে কিছু কথা বলে। ওয়েটিং রুমটা অবশ্য বেশি বড় না। চার পাচটা সিংগেল সোফা। মাঝে একটা কাচের টেবিল। তার উপর কিছু পেপার ম্যাগাজিন রাখা। নুসাইবা এসে সাফিনার কাছের সোফাটাতে বসে। ছেলেটা নুসাইবার দিকে তাকায়। নুসাইবা বলে আমার একটু দেরি হবে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে তারপর আসব। ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে বাইরে চলে যায়। সাফিনা অবাক হয়ে সব লক্ষ্য করে। নুসাইবা দরজার দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হয় ছেলেটা নেই। কাউন্টারে বসা মেয়েটা মোবাইলে স্ক্রল করছে। নুসাইবা এইবার সাফিনার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেয়। সাফিনা বলে এইসব কি হচ্ছে নুসাইবা? ছেলেটা কে? তোর চেহারার এই হাল কেন? নুসাইবা তখন আস্তে আস্তে সাফিনা কে সব বলতে থাকে। আসলে কি বলবে ঠিক করে এসেছে আগে থেকে। সাফিনা যত কম জানবে তত ভাল সাফিনা আর ভাইয়ার জন্য। তবে সাফিনার হেল্প লাগবে। সাফিনা কে আগে আরশাদের ব্যাপারে বলেছিল কিছু। তাই সেখান থেকে শুরু করে। কিভাবে সানরাইজ গ্রুপ আরশাদ কে সরিয়ে নিয়েছে। ইচ্ছা করে ম্যানেজারের নামটা বলে না। মুন্সির কথা গোপন করে বলে, সানরাইজ গ্রুপের প্রতিপক্ষও ওকে হুমকি দিচ্ছে। আর এই ছেলেটাকে রাখা হয়েছে নুসাইবার নিরাপত্তা আর সাথে ওর উপর নজর রাখার জন্য। সাফিনার মুখ হা হয়ে যায়। কি বলছে এইসব নুসাইবা। একবার বলে চল পুলিশের কাছে যাই। নুসাইবা বলে পাগল হয়েছ ভাবী। এরা পুলিশ কে কিনে রেখেছে। আর পুলিশের কাছে গেলে আরশাদের কি হবে। এরা আরশাদ কে আস্ত রাখবে না তখন। সাফিনার প্রচন্ড রাগ হয় আরশাদের উপর। এতদিন ধরে আরশাদ কে সোনার টুকরা ছেলে ভেবেছে কিন্তু কেউ এমন ভাবে নিজের বউ কে বিপদে ফেলে। তার উপর মদ জুয়া এইসব। সাফিনা বলে তোর আরশাদের ব্যাপারে ভাবতে হবে না। ও কি এইসব করার সময় তোর ব্যাপারে ভেবেছে, তুই কি বিপদে পড়বি ভেবেছে? তোর সেফটি নিশ্চিত করা দরকার। তুই আজকে এখনি আমাদের বাসায় চল। আমাদের বাসায় থাকবি তুই। নুসাইবা বলে বুঝতে পারছ না ভাবী এত তোমরা বিপদে পড়বে। আপাতত এইভাবে চলতে দাও। আর আরশাদের উপর আমার রাগ আছে তবে ওর খুব বড় কিছু হোক সেটা আমি চাই না। ওর সাথে আমি বোঝাপড়া মেটাব ও ফেরত আসলে। তার আগে এই বিপদ থেকে বের হতে হবে। সাফিনার মাথায় কিছু ঢুকে না। কিভাবে এইসব সামলাবে একা নুসাইবা। নুসাইবা বলে আমার উপর আস্থা রাখ ভাবী। আপাতত আমার টাকার দরকার কিন্তু আমার একাউন্ট থেকে তুলতে পারব না। তাহলে ওরা জেনে যাবে। তুমি তোমার একাউন্ট থেকে পাচ লাখ টাকা তুলতে পারবে? এরপর আগামী বৃহস্পতিবার এইখানে আসবে সেইম টাইমে। একটা পলিথিনে টাকাটা মুড়িয়ে রাখবে। আর আসলে অন্য সবার সামনে আমাকে না চেনার ভান করবে। ওয়েটিং রুমের টয়লেটটা দেখিয়ে বলে প্রথমে তুমি ঐখানে যাবে টাকার পলিথিনটা রেখে আসবে। আমি সাথে সাথে ভিতরে ঢুকব আর টাকাটা নিব। তবে তুমি এর মাঝে আমাকে আর ফোন করবে না। আমি দরকার মত ফোন করব। সাফিনা বলে এই টাকা দিয়ে তুই কি করবি। নুসাইবা বলে আপাতত তোমার না জানা ভাল। এর মধ্যে সাফিনার ডাক আসে কাউন্সিলিং এর। নুসাইবা কাউন্টারে গিয়ে বলে বৃহস্পতিবার আসব আমি। কাউন্টারের মহিলা বলে ওকে তাহলে সেদিন আমি আপনার জন্য পরের কোন দিন শিডিউল ফ্রি আছে খুজে রাখব। সেখান থেকে বের হয়ে পড়ে নুসাইবা। প্রথম কাজটা শেষ।

দ্বিতীয় কাজের জন্য আরেক জনের হেল্প দরকার। সন্ধ্যার দিকে বাসার কাজের বুয়া আসবে। সেখান থেকে নিতে হবে পরের স্টেপ। বাসায় সাতটার দিকে কাজের বুয়া আসল। এই মহিলা গত প্রায় সাত আট বছর ধরে ওদের বাসায় কাজ করে। যথেষ্ট হেল্পফুল, বিশ্বস্ত। মহিলার ছেলে গত বছর কলেজে ভর্তি হবার সময় নুসাইবা ভর্তির পুরো টাকা দিয়েছে। এছাড়াও অসুখ বিসুখে এক্সট্রা টাকা দেয়। ফলে এই মহিলা নুসাইবা কে খুব পছন্দ করে। মহিলা আসতেই নুসাইবা বলে তোমার ফোনটা দাও তো বুয়া। আমার ফোনে ডিস্টার্ব দিচ্ছে। এক জায়গায় ফোন করতে হবে। টাকা ভরা আছে তোমার ফোনে? বুয়া বলে আইজাকা বিকালেই ৫০ টাকা ভরছি আপা। নুসাইবা বলে ঠিক আছে তাহলে। আমার একটা জায়গায় ফোন করা দরকার। একটু সময় লাগবে কথা বলতে। তুমি কাজ কর। এরপর আমি আবার তোমাকে ১০০ টাকা দিয়ে দিব নে ফোন রিচার্জ করার জন্য। বুয়া খুশি হয়। ফোনটা নিয়ে নিজের রুমে এসে মাহফুজের নাম্বারে ফোন দেয়। দুইবার ফোন বাজলেও ফোন ধরে না মাহফুজ। এইবার একটা মেসেজ পাঠায় নুসাইবা। মাহফুজ আমি নুসাইবা ফোনটা ধর। এরপরের বার কল দিতেই মাহফুজ ফোনটা ধরে। মাহফুজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে এইটা কার নাম্বার। নুসাইবা বলে বলছি প্লিজ আমাকে আগে কথা বলতে দাও। নুসাইবার গলায় তাড়া টের পায় মাহফুজ। ঐপাশ থেকে মাহফুজ কিছু বলে না। নুসাইবা মাহফুজ কে কি বলবে এই কয়েক ঘন্টায় তার প্রাকটিস করেছে। সেইভাবে বলতে থাকে। তবে কথা কথা বলতে গিয়ে নুসাইবা টের পায় ওর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে উত্তেজনায়। কারণ ওর প্ল্যানের মূল অংশটা সফল করার জন্য মাহফুজের সাহায্য দরকার। মাহফুজকে বুঝানো দরকার কতটা সাহায্য প্রয়োজন ওর। ম্যানেজার আর মুন্সী দুইজনের কথাই তাই বলে তবে মুন্সীর রাতের বেলার কান্ডকীর্তির কিছুটা বলে কিছুটা গোপন রাখে। পিস্তল দিয়ে ভয় দেখানোর কথা বললেও বাকিটা গোপন রাখে নুসাইবা। টানা দশ মিনিট সাজানো কথা গুলো হড়বড় করে বলে যায়। বলা শেষে টের পায় গলা কাপছে, চোখের কোনা দিয়ে পানি পরছে। ওর মনে হয় মাহফুজ ওর সামনে নেই এটা ভাল হয়েছে।

মাহফুজের মন মেজাজ এমনিতে গত কয়েক দিন ধরে ভাল নেই। সিনথিয়া পরীক্ষার ব্যস্ততায় ঠিক মত কথা বলতে পারছে না। সাবরিনা গত একমাস ধরে দেশের বাইরে একটা ট্রেনিং এর জন্য। আর দুই মাস আসবে না দেশে। আর নুসাইবার সাথে ফ্লোরার দোকানের ঘটনার পর সব যেন এক রকম জট পাকিয়ে গেছে। ওর জীবনে আশেপাশে সব নারীরা যেন এখন ব্যস্ত না হলে দূরে সরে গেছে। এটা ভাবতেই নিজের মনে প্রশ্ন আসে সাবরিনা আর নুসাইবা কে কি হিসেবে নিজের বলে ভাবছে ও। সাবরিনার সাথে যে আকর্ষণ ওর দিক থেকে শুরু হয়েছিল সেই আকর্ষণের জ্বালে সাবরিনাও ভালবাবে জড়িয়েছে এটা বুঝে মাহফুজ। এই সম্পর্কের পরিণতি নেই সেটাও জানে। আবার সাবরিনা যদি জানে সিনথিয়ার সাথে ওর সম্পর্ক তাহলে এটার পরিণতি কি হবে সেটাও জানে না। আর সিনথিয়া যদিও এমনিতে সেক্স টকের সময় সাবরিনা কে নিয়ে কথা বলে তবু সত্যি সতি সাবরিনা আর ওর সম্পর্ক জানলে কি বলবে সেটা পুরো আনপ্রেডিকটেবল। এর মাঝে নুসাইবা। বারমুডা ট্রায়াংগল। যে আকর্ষণে পড়লে নিস্তার নেই। মেয়েদের সাথে সম্পর্ক মাহফুজের জন্য সব সময় একটা ইজি ব্যাপার ছিল। মেয়েরা বরাবর ওর আকর্ষণে পড়েছে। কিন্তু সিনথিয়ার পরিবারের মেয়ে গুলো যেন পাশার দান উলটে দিয়েছে ওর জন্য। সুন্দরী মেয়ে কম দেখে নি মাহফুজ, কম সুন্দরীর সাথে মিশে নি। তবে এমন ভাবে উইক হয় নি কখনো। সিনথিয়ার ফ্যামিলির মেয়েদের জিনে যেন ওকে হারানোর রহস্য মিশে আছে। এক উদ্দ্যেশ সাধন করতে এসে যেন নতুন দুই ফাদে জড়িয়ে গেছে। এইসব ভেবে ভেবে মন মেজাজ তীরিক্ষে হয়ে ছিল। এমন সময় অচেনা একটা নাম্বার থেকে পর পর দুইবার ফোন আসল। ফোন ধরে না মাহফুজ। প্রতিদিন কত আজগুবি ফোন আসে। পলিটিক্যাল ফোন, বিজনেসের কাজে ফোন। ফোন ধরার ব্যাপারে সব সময় খুব সচেতন মাহফুজ। সহজে ফোন মিস করে না। কোন কারণে ধরতে না পারলেও কল করে বা টেক্সট দেয়। আজকে আর এইসব কিছুই করতে ইচ্ছা করছে না। সারাদিন টেন্ডারের কাজ নিয়ে বেশ ছুটোছুটি করতে হয়েছে। তার উপর সিনথিয়া, সাবরিনা আর নুসাইবার চিন্তা। তাই ফোন ধরে না। এর পর একটা টেক্সট। ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে মেসেজটা দেখে। মাহফুজ আমি নুসাইবা ফোনটা ধর। অবাক হয় মাহফুজ। নুসাইবা নামের এক জনকেই চিনে ও। কিন্তু কার নাম্বার এটা? ভাবতে ভাবতে আবার ফোন বাজে, সেই নাম্বার। হ্যালো বলেই জিজ্ঞেস করে কার নাম্বার এটা? নুসাইবা বলে আগে আমাকে কথা বলতে দাও প্লিজ। নুসাইবার গলায় অস্থিরতা। একটু বিরক্ত হয় সব সময় নিজের কথা আগে বলতে হবে, তবু বলে বলুন।

নুসাইবার কথা শুনতে শুনতে সজাগ হয়ে উঠে মাহফুজের মন। সত্যি বলছে নুসাইবা? এইসব কারণেই কি আরশাদ ওকে ফোন দিয়ে খেয়াল রাখতে বলেছিল নুসাইবার? লোকটা গাড়ল না শয়তান? এইভাবে বউ কে বিপদে ফেলে যায় নাকি কেউ? সানরাইজ গ্রুপের নিষ্ঠুরতার গল্প রাজনৈতিক মহলের সবাই কমবেশি জানে। ম্যানেজার লোকটাকে কয়েকবার পার্টি অফিসে দেখেছে আনোয়ার খান আর আজিম খানের সাথে। আর এই মুন্সী লোকটা কে? একজন উচ্চপদস্থ সরকারী অফিসারের বাসায় পিস্তল নিয়ে ঢুকে ভয় দেখিয়ে যায়? কে আছে এর পিছনে? বানানো কোন গল্প না তো? কিন্তু এমন নিখুত বর্ণ্নায় গল্প বানাতে হলে তো নোবেল পাওয়া লেখক আনতে হবে। নুসাইবার কথা শুনার সাথে সাথে মাহফুজের চোয়াল দৃঢ় হয়। চ্যালেঞ্জ প্রিয় ভিতরের মানুষটা মাথা তুলে দাঁড়ায়। নুসাইবার প্রতি ক্ষোভ আর এট্রাকশনের পাশে ভিতরের চ্যালেঞ্জ প্রিয় মানুষটা দাঁড়ায়। মনের ভিতর যেন বলে উঠে নুসাইবা কে বাচাতে হবে যে কোন মূল্যে। এট্রাকশন না মানুষ কে উপকারের নেশা কোনটা তাড়া দেয় মনের ভিতর নিজেই জানে না মাহফুজ। তবে জানে কিছু একটা করতে হবে। তাই এইবার নুসাইবা কে প্রশ্ন করে করে আর খুটিয়ে সব জানতে থাকে মাহফুজ। নুসাইবার প্ল্যান, ম্যানেজার, মুন্সী সব।



সোলায়মান গতকাল রাতে মাহফুজের ফোন পেয়ে অবাক হয়। রাত দশটার সময় ফোন দিয়ে দেখা করবার জন্য অনুরোধ করে। সাধারণত একবার বাসায় আসলে যদি অফিসের সিনিয়র বা বস কেউ না ডাক দেয় তাহলে কাজের জন্য বাইরে বের হয় না। তবে মাহফুজের গলায় তাড়া টের পায় আর মাহফুজ বারবার বলতে থাকে খুব জরুরী কাজটা। ফোনে কথা বলতে বলে। মাহফুজ প্রাথমিক ভাবে কয়েকটা কথা বলার পর সোলায়মান শেখ বাসার কাছের এক রেস্টুরেন্টের ঠিকানা বলে। রাত একটা পর্যন্ত খোলা থাকে সেটা। দোকানটা একটা গলির মুখে। বেশ চালু রেস্টুরেন্ট। তবে ঠিক টাকা ওয়ালাদের জায়গা না এটা। বরং বলা যায় একটু ভাল ভাতের হোটেল। যেখানে বেশ ভাল করে বসা যায়। খাওয়ার মান ভাল, টাকাও অপেক্ষাকৃত কম নেয়। তাই সকাল ছয়টায় খোলার পর থেকে রাত একটা পর্যন্ত ভীড়ের উপর থাকে। তবে সোলায়মান কে ডিবির লোক বলে সম্মান করে মালিক। আসলে কোণার একটা কেবিনের মত জায়গা আছে সেটা বসার জন্য ছেড়ে দেয়। আর চারপাশে এত কথা, মানুষ যে কেউ খেয়াল করবে না কে কি বলছে। তাই মাহফুজ কে এখানে আসতে বলে। সময়মত হাজির হয় মাহফুজ। এইজন্য মাহফুজ ছেলেটাকে পছন্দ করে সোলায়মান। মাথায় বুদ্ধি যেমন আছে তেমন করে সময়ের দাম দেয়, আর কথা দিলে কথা রাখে। মাহফুজের মুখে চিন্তার রেখা দেখে সোলায়মান। অবশ্য চিন্তা হবার মত কথা। যা বলল তাতে মনে হচ্ছে ভাল একটা ফ্যাসাদে ফেসে গেছে আরশাদ সাহেব আর তার বউ। মাহফুজ টেবিলে বসে একে একে নুসাইবার কাছ থেকে শোনা সব কথা আর পার্টি অফিসে নেওয়া খোজ থেকে যা জেনেছে সব বলে সোলায়মান কে। সোলায়মান মনযোগ দিয়ে সব শুনে।

নুসাইবার সাথে কথা বলার পর পার্টি অফিসে ফোন দিয়ে খোজ নেয় সানরাইজ গ্রুপ সম্পর্কে আর তাদের প্রতিদন্দ্বী ওশন গ্রুপ সম্পর্কে। দুই কর্পোরেট হাউজের প্রতিদন্দ্বীতা এখন ভোটের মাঠে এসে হাজির হয়েছে। এক আসন থেকেই নির্বাচন করতে চায় দুই দল। সানরাইজ গ্রুপের মালিকের ছেলে আর ওশন গ্রুপের মালিক। এর আগে এক সময় এই আসন থেকে এমপি ছিল ওশন গ্রুপের মালিক। পরে নানা কারণে আর নমিনেশন পায় নাই। এইবার আবার নমিনেশনের জন্য জোর তদবির করছে। তবে ভিতরে ভিতরে নিউজ হচ্ছে সানরাইজ গ্রুপের মালিকের ছেলে পাবার চান্স বেশি নমিনেশন। ছেলে রাজনীতির মাঠে নতুন তাই তেমন কোন স্ক্যান্ডাল নেই পিছনে। তার উপর ছেলে পলিটিক্যালি বুদ্ধিমান আছে। মাহফুজের সাথে মাসুদ চাচার ঐখানে কথা হয়েছে সানরাইজ গ্রুপের মালিকের ছেলের। মাহফুজ নিজেও স্বীকার করে বড়লোকের রাজনীতি করতে চাওয়া ছেলেদের তুলনায় এই ছেলে অনেক বেশি বুদ্ধি রাখে। তবে পার্টি অফিস থেকে আরেকটা খবর পেয়েছে মাহফুজ ওশন গ্রুপে দেদারছে টাকা ঢালছে নমিনেশন পাবার জন্য। নুসাইবা থেকে শোনা খবর এর সাথে এই বার দুইয়ে দুইয়ে চার মিলায় মাহফুজ। মুন্সী তাহলে সম্ভবত ওশন গ্রুপের লোক। আর যেভাবে আরশাদের ফাইলপত্রের খোজ করছে তার মানে সানরাইজ গ্রুপের খবর বের করার জন্য লেগেছে এই লোক। আর পার্টি অফিসের খবরে এটাও বুঝে দুই দল মরিয়া নমিনেশন পাবার জন্য। দরকার হলে দুই একটা লাশ ফেলে দেওয়া, মিথ্যা খবর তৈরি করা সব সম্ভব এই দুই দলের পক্ষে। মাহফুজের একটা গিল্ট ফিলিংস কাজ করে কারণ আরশাদের সাথে সানরাইজ গ্রুপের সম্পর্কের খবর ঐ পত্রিকার নিউজ না হলে হয়ত এইভাবে সামনে আসত না। ফলে আরশাদ বিপদে পড়ত না। আর তার থেকে নুসাইবা এত ঝামেলায় ফেসে যেত না। জেনে বুঝে মানুষের বড় কোন ক্ষতি করতে কখনো চায় না মাহফুজ। কিন্তু এইটা বুঝে আরশাদ বিশেষ করে নুসাইবা কে বড় বিপদে ফেলে দিয়েছে সে। এখান থেকে খুব খারাপ কিছু হলেও হয়ে যেতে পারে।

মাহফুজের কাছে পার্টি অফিসের খবর আর নুসাইবার সাথে মুন্সী আর ম্যানেজারের নজরদারির কথা শুনে ভ্রু কুচকায় সোলায়মান শেখ। অনেক বছর ডিবিতে চাকরি করার জন্য ঢাকার রাঘববোয়ালদের অনেক কথায় জানে সে। ম্যানেজার হচ্ছে সানরাইজ গ্রুপের সব ইলিগ্যাল কাজ সামলায়। এমনকি সোলায়মান শেখের বসরাও বেশ সমীহ করে কথা বলে এই লোকটার সাথে। আর মুন্সী একটা নরকের কীট। কয়েকবার লোকটাকে হেল্প করতে হয়েছে ওর বসদের নির্দেশে। কি জানি কি জাদু আছে মুন্সীর। এই লোক কোন না কোন ভাবে তার প্রায় সব বসদের জাদু করে রেখেছে। ব্লাকমেইলিং এই লোকের পেশা এবং নেশা। সম্ভবত তার বসদের সম্পর্কেও কিছু না কিছু জানা আছে এই লোকের। যেভাবে অল্প কিছু ইনফরমেশন থেকে মানুষের বেডরুমের খবর পর্যন্ত বের করে ফেলে তাতে অবাক হয়েছে সোলায়মান অনেকবার। তবে এই লাইনে কাজ করা সব মানুষের কিছু নীতি থাকে। মুন্সীর কোন নীতি আছে বলে মনে হয় না। মানুষ কে মেন্টালি টরচার করা এই লোক উপভোগ করে ব্লাকমেইলিং করে। খালি টাকার জন্য কাজ করে এইলোক তেমন না বরং এই লোক কাজটা উপভোগ করে। পারত পক্ষে মুন্সী কে এড়িয়ে যেতে চায় সব সময় সোলায়মান শেখ। তবে আজকে যখন মাহফুজ বলল আরশাদ সাহেব আর তার বউ দুইজনের উপর ম্যানেজার আর মুন্সী নজর রাখছে তখন সোলায়মানের মনে হল জলে কুমীর আর ডাংগায় বাঘের উপযুক্ত ব্যবহার সম্ভবত আরশাদ সাহেব আর তার বউয়ের বর্তমান অবস্থা।

সোলায়মান জিজ্ঞেস করে এখন আপনার প্ল্যান কি? মাহফুজ বলে ভাই শুনেন আপনি তো ঘটনাটা শুরু থেকে জানেন। আমি আমার গার্লফ্রেন্ড কে বিয়ে করবার জন্য উনাদের রাজি করানোর জন্য সব শুরু করছিলাম। আপনি আরশাদ সাহেব সম্পর্কে আমাকে খবর জোগাড় করে দিছেন, সেই খবর দিয়ে পত্রিকায় নিউজও হয়েছে। কিন্তু এখন উনারা সেই নিউজ থেকে এমন বিপদে পড়ে যাবে আমি সেইটা আশা করি নি। সোলায়মান শেখ মাহফুজের গলায় গিল্ট ফিলিংস টের পায়। সোলায়মান ভাবে তার অনুমান ঠিক, ছেলেটার দিল পরিষ্কার। সোলায়মান বলে তা আপনি কি চান? মাহফুজ বলে আরশাদ সাহেব কে তো ঠিক উদ্ধার করার আপাতত কোন উপায় নায়। মনে হচ্ছে সানরাইজ গ্রুপ উনাকে কোথাও নিজেদের হেফাজতে রেখেছে। তবে উনার বউ কে আমাদের উদ্ধার করতে হবে। সোলায়মান শেখ বলে কাজটা সহজ হবে না। আপনি যাদের কথা বলছেন, এই মুন্সী বা ম্যানেজার এদের সাথে আমার কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। ঢাকা শহরের বাঘা বাঘা ক্রিমিনালরাও এদের সমজে চলে। পুলিশের বড়কর্তাদের ড্রয়িংরুম পর্যন্ত এদের দৌড়। আর সাথে আছে দুইটা বড় কর্পোরেট হাউজের টাকা। ফলে কাজটা মোটেও সহজ হবে না বরং বেশ ডেঞ্জারাস। আপনার মাথায় কোন প্ল্যান আছে? মাহফুজের মাথায় এই অল্প কয়েক ঘন্টায় কোন প্ল্যান আসে নি। তবে নুসাইবা একটা বুদ্ধি দিয়েছে। নুসাইবার ইংল্যান্ডের ভিসা করানো আছে। সেখানে ওর ভাইরা থাকে। কোনভাবে বাসা থেকে বের হয়ে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌছাতে পারলে সহজেই ইংল্যান্ড পৌছাতে পারবে। সেখানে যদি কোন ভাবে ইলেকশন পর্যন্ত সময়টা কাটানো যায় তাহলে হয়ত পরে সব ঠিক হয়ে আসবে।

সোলায়মান বলে ভাই ব্যাপারটা আরশাদ সাহেবের বউ যেভাবে ভাবছে এত সহজ না মোটেই। আমার এই ম্যানেজার আর মুন্সীর সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এই দুই দলের পকেটে ঢাকা শহেরের শত শত পুলিশ। আমার ডিবির কলিগরাও তাদের হয়ে কাজ করে। আমি নিজেও মাঝে মধ্যে করি। ফলে উনি বাসা থেকে বের হলেই সহজে ইমিগ্রেশন পার হতে পারবেন বলে মনে হয় না। আমি আগেও এমন কয়েকটা কাজ দেখছি। ইমিগ্রেশনে মানুষের পার্সপোর্ট নাম্বার দিয়ে রাখা থাকে। ফলে আপনি পার্সপোর্ট স্ক্যান করা মাত্র এরা সজাগ হয়ে যাবে। এয়ারপোর্টে থাকা নিজেদের লোক দিয়ে হয় আপনাকে কিডন্যাপ করাবে নাহলে নানা অযুহাতে প্লেনে উঠতে দিবে না। দুইটার রেজাল্ট সেইম মানে আপনি ওদের হাতে এরপর আর ভালভবে বন্দী হয়ে যাবেন। আর আমি চাইলেও সরাসরি আপনাদের হেল্প করতে পারব না। আমাকে মুন্সী আর ম্যানেজার দুইজন ভাল করে চিনে, তাদের অনেক লোকও আমাকে চিনে। ফলে এই সিসি ক্যামেরার যুগে কোনখানে আমার চেহারা দেখলে আমার চৌদ্দগুষ্ঠী উদ্ধার করে দিবে। যেখানে আরশাদ সাহেবের মত সরকারী ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসারের পাত্তা নাই সেখানে আমার মত একজন সেকেন্ড ক্লাস ডিবি ইনেসপেক্টর কে হাওয়া করা এদের জন্য ব্যাপার না। আর আরশাদ সাহেব বা উনার বউয়ের মত হাই প্রোফাইল লোকরা পালানোর সময় প্রথম বিদেশের কথা ভাবে এইটা সবাই জানে, ফলে উনাদের জন্য এয়ারপোর্ট বা কোন বর্ডার দিয়ে গোপনে পালানো প্রায় অসম্ভব। আর যে পরিমাণ টাকা এরা ঢালবে সেটার জন্য উনি বিদেশে গেলেও খুব নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন বলে মনে হয় না। আমি এমন কিছু কেস জানি, যেখানে ভিক্টিমরা ভাবছে দেশ থেকে বের হতে পারলেই বেচে গেছে। পরে বিদেশের মাটিতে টাকা দিয়ে ঐদেশের লোকদের দিয়ে শায়েস্তা করেছে ভিক্টিমদের। মাহফুজ ব্যাপারটা এইভাবে ভেবে দেখে নি।

মাহফুজ বলে তাহলে এখন উপায় কি? সোলায়মান শেখ গাল চুলকায়। গাল চুলকাতে চুলকাতে বলে উপায়টা আসলে সহজ। আরশাদ সাহেবের বউকে লুকাতে হবে দেশের ভিতর কোথাও। তবে এরজন্য প্রথমে উনারে বাসা থেকে বের করতে হবে। সেই কাজটা আপনি করবেন। আমি ভুলেও সেইদিকে যাব না। কারণ একবার আমার চেহারা দেখলে ওরা এরপর আরশাদ সাহেবের বউ হাওয়া হলে আমার পিছনে লাগবে। আর একবার বের হলে কোথায় কিভাবে উনাকে রাখা যায় সেইটা আমি একটু খোজ করে দেখছি। এরপর মাহফুজ আর সোলায়মান বসে রেস্টুন্টের ভীড়ের মাঝে দেশের দুইটা টপ কর্পোরেট হাউজ আর তাদের ধুরন্দর দুই সাগরেদ কে এড়ানোর খসড়া পরিকল্পনা করতে থাকে।



সাফিনা করিম সাইকোলজিস্ট এর সামনে বসে আছে। আজকে অবশ্য একটু পর পর ডান কোণায় দেয়ালে ঝুলানো বড় ঘড়িটার দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। কখন সেশন শেষ হবে। অন্যদিন সেশন আরেকটু বেশি চললে খুশি হয় তবে আজকে সেশন তাড়াতাড়ি শেষ হোক এটাই চাচ্ছে। আবার নিজের অস্থিরতা প্রকাশ করতে পারছে না। নুসাইবা বলে দিয়েছে কোন ভাবে যেন অন্য কেউ বুঝতে না পারে। সাফিনা করিম তাই আজকে নিজের অস্থিরতা খুব সচেতন ভাবে গোপন রাখার চেষ্টা করছেন। আজকে বৃহস্পতিবার। নুসাইবার কথামত টাকা ব্যাংক থেকে তুলে একটা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগে মুড়িয়ে নিজের ব্যাগে রেখেছেন। নুসাইবা চলে আসার কথা এর মধ্যে। উনি এখন সাইকোলজিস্ট এর অফিস থেকে বের হয়ে ওয়েটিং রুম এর লাগোয়া ওয়াশরুমে যাবেন। টাকার ব্যাগটা ট্রাশ ক্যানের পিছনে রেখে বের হয়ে আসবেন। নুসাইবা আগে থেকে ওয়াশরুমের সামনে দাড়ান থাকবে যেন মনে হয় ওয়াশরুমে যাবার তাড়া আছে। উনি বের হলে নুসাইবা ভিতরে ঢুকে নিজের ব্যাগে টাকাটা নিয়ে নিবে। নুসাইবা এই টাকা দিয়ে ঠিক কি করবে সেটা বলে নি সাফিনা কে। আবার আরশাদের ঘটনাটা নিয়ে সমস্যাটা কেমন সেটা খানিকটা বললেও সাফিনা টের পাচ্ছে নুসাইবা অনেক কিছুই লুকাচ্ছে। সাফিনার কোন বোন নেই। এত বছর ধরে নুসাইবাকেই নিজের বোন ভেবে এসেছে। তাই নুসাইবার জন্য চিন্তা হচ্ছে খুব।

সাইকোলজিস্ট আদিবা রহমানের এই দুই মাস ধরে সাফিনা করিমের বেশ অনেকবার সেশন নিয়েছেন। সেই সব সেশনের উপর ভিত্তি করে সাফিনা করিমের মানসিক অবস্থার একটা ধারণা পেয়েছেন। ডিপ্রেশন আইন্ডেন্টিফাই করার জন্য কিছু বেসিক সাইকোলজিক্যাল টেস্ট আছে। সেই সব গুলা বেশ কয়েকবার করে টের পেয়েছেন যে সাফিনার হালকা ডিপ্রেশন আছে। এই অবস্থায় সাধারণত ভাল ভাবে এড্রেস করতে পারলে ব্যাপারটা অল্পতে কন্ট্রোল করা যায়। ঔষুধ সাজেশন না দিয়েই খালি থেরাপি সেশনের মাধ্যমে কন্ট্রোল করা যায়। আজকে তাই সামনে কিভাবে এই ডিপ্রেশন কন্ট্রোল করা যায় এবং তার জন্য কি কি করতে হবে সেটা নিয়ে একটা ডিটেইলড প্ল্যান আলোচনা করছেন আদিবা। তবে আদিবা খেয়াল করলেন সাফিনা সেইভাবে মনযোগ দিয়ে কথা শুনছে না। ডিপ্রেশনের রোগীরা অনেক সময় মনযোগ ধরে রাখতে পারে না। অল্পতে রেগে যায়। প্রচন্ড মুড সুইং হয়। আদিবা রহমান নিজের নোট খাতার দিকে তাকান, অল্প অল্প করে সব গুলো লক্ষণ আছে সাফিনা করিমের মধ্যে। এই বয়সের এমন আর কয়েকজন রোগী পেয়েছেন আদিবা রহমান। সবার ডায়াগনসিস প্রায় সেইম। স্বামীরা এই বয়সে এসে ওয়াইফদের উপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, কেউ বাইরে অন্য নারী খুজেন, কেউ কর্মজীবনে আর বেশি মনযোগ দেন। বাচ্চা কাচ্চারা বড় হয়ে যায় ফলে মায়ের দরকার তাদের জীবনে প্রায় নাই হয়ে যায়। আর তার উপর মধ্য বয়সের জীবনের হতাশা। সব মিলিয়ে একটা আইন্ডেন্টিটি ক্রাইসিস শুরু হয়ে যায় মহিলাদের। সাফিনা করিম তার মধ্যে দিয়েই যাচ্ছেন। বাচ্চা আর সংসারে মনযোগ দিতে গিয়ে কাজে সময় দিয়েছেন কম। তাই সম বয়সী অনেকের তুলনায় কর্মজীবননে খানিকটা পিছিয়ে আছেন। সেটা সাফিনা কে পীড়া দেয়। আবার এই যে দুই মেয়ে বড় হয়ে যার যার মত জীবনে ব্যস্ত, মায়ের জন্য সময় কম সেটাও তার মনে অভিমান তৈরি করে। আর হাজব্যান্ড কাজে এত ব্যস্ত সেটাও সাফিনার মনে ক্ষোভ জন্ম দিয়েছে। সংসারের জন্য সময় দেওয়ার কারণে ঢাকার বাইরে পোস্টিং নেয় নি, নিলে আজকে কোন কলেজের প্রিন্সিপাল হতে পারত। আর হাজব্যান্ড খালি কাজে সময় দিচ্ছে যাতে আর উপরে উঠতে পারে। সাফিনার মানসিক অবস্থার দিকে খেয়াল নেই যেন। ক্লাসিক মিড লাইফ ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সাফিনা। একজন ভাল সংগী দরকার যার সাথে সুখ দুখের কথা শেয়ার করতে পারবে সাফিনা। পরিবারে সদস্যদের আর মনযোগ দেওয়া দরকার সাফিনার প্রতি। আর সাফিনার দরকার সেলফ কেয়ার। নিজের সুখ, ইচ্ছা গুলোর দিকে আর মনযোগ দেওয়া।

সাফিনা, সাইকোলজিস্ট যা বলছে তাতে খালি হু হা করে যাচ্ছে। আজকে দ্রুত বের হতে হবে। ঘড়ির কাটা পাচটা বাজতেই সাফিনা বলে আজকে তাহলে উঠি। সাইকোলজিস্ট আদিবা রাহমান আজকে আর আটকান না। রোগীর মেজাজ মর্জি বুঝে চলা সাইকোলজিস্টদের বড় গুণ। রুম থেকে বের হয়ে চোখের কোণা দিয়ে তাকায় সাফিনা। এক কোণায় বসে আছে নুসাইবা। আর আরেক সাইডে একটা সিংগেল সোফায় বসে আছে আরেকজন লোক। হয়ত পরের রোগী। নুসাইবার কথামত নুসাইবা কে না চেনার ভান করে বাথরুমে ঢুকে। ঢুকে ঘড়ি দেখে পাচ মিনিট অপেক্ষা করে। এরপর বের হয়ে কোন দিকে না তাকিয়ে বের হয়ে যায়। বের হবার সময় ঘাড় ঘুড়িয়ে একবার পিছনে তাকায়। বাথরুমের দরজা দিয়ে ঢুকছে নুসাইবা।

নুসাইবার বুক উত্তেজনায় ধক ধক করছিল। আধা ঘন্টা ধরে এসে বসে আছে। ভাবী কখন বের হবে। এর মধ্যে একটা লোক এসে বসল ওয়েটিং রুমে। সামনে থাকা টেবিলের উপর ম্যাগাজিনগুলো নিয়ে উলটে পালটে দেখছে। মাঝে মাঝে আড়চোখে ওকে দেখছে টের পাচ্ছে নুসাইবা। মোবাইলের স্ক্রিনে স্ক্রল করতে করতে নিজের উত্তেজনা চেপে রাখার চেষ্টা করছে। লোকটা কি ম্যানেজার বা মুন্সীর কার লোক? নাকি ডাক্টার আদিবা রহমানের কোন পেসেন্ট। আদিবা রহমান কোন পেসেন্ট নেবার আগে একটা আধা ঘন্টার প্রি স্ক্রিনিং সেশন করেন। আজকে সেটা হবার কথা। সেই জন্য টাইম নিয়েছে। তবে সেটা আর ঘন্টা দেড়েক পরে। নুসাইবার অবশ্য ইচ্ছা নেই সেখানে থাকার। ওর প্ল্যান খালি টাকাটা নেওয়া। ভাবী বের হয়ে কোন দিকে না তাকিয়ে বাথরুমে ঢুকল। এর মধ্যে সময় যেন আর কাটছে না। ভাবী কে বলেছিল যেন অন্তত মিনিট পাচেক ভিতরে বসে থেকে তারপর বের হয়। নুসাইবার কাছে প্রতিটা সেকেন্ড এখন ঘন্টার মত মনে হচ্ছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ভাবী বের হয়ে আবার কার দিকে না তাকিয়ে বের হয়ে গেল। নুসাইবা তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকল। ট্রাশ ক্যানের পাশেই পলিথিনের ব্যাগ। উপরে একটা খাম রাখা। নুসাইবা খামটা খুলল। ভাবীর হাতের লেখা। যত চেয়েছিলি তার থেকে দুই লাখ বেশি আছে। সাবধানে থাকিস। আর কিছু লেখা নেই। তাড়াতাড়ি চিঠি আর টাকার ব্যাগটা নিজের বড় হ্যান্ডব্যাগে ঢুকায়। ভিতরে চার পাচ মিনিট অপেক্ষা করে। এরপর বের হয়ে আবার ওয়েটিং রুমে বসে। প্ল্যান মত আর দশ মিনিট ওয়েট করে। এর মধ্যে আরেকজন লোক আসে। সে ডাক্টার আদিবা রহমানের রুমে ঢুকে যায়। যেই লোকটা প্রথমে এসেছিল সে এখনো ম্যাগজিন উল্টানোর ভংগীতে নুসাইবা কে আড়চোখে দেখছে। সুন্দরী হবার কারণে ছেলেদের চোরাচাহনি সবসময় দেখে এসেছে। অন্যদিন বিরক্ত হলেও আজকে মনে মনে দোয়া করছে যেন এই লোকটা ওকে সৌন্দর্যের জন্য এইভাবে আড়চোখে দেখে। মুন্সী বা ম্যানেজারের লোক হলে কি হবে ভাবতে গলা শুকাচ্ছে। ওর প্ল্যানের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে এই টাকা। এরপর আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে কাউন্টারের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। মেয়েটা বলে ম্যাডাম ভিতরে তো একজন পেসেন্ট আছে। আর সেশন প্রায় এক ঘন্টার। তাই আপনাকে অতক্ষণ ওয়েট করতে হবে। নুসাইবা বলে আমার আসলে একটা কাজ পড়ে গেছে। আজকে যেতে হবে। পরে কি রিশিডিউল করা যায়। মেয়েটা বলে আগামী সাপ্তাহে কিছু হবে না। তার পরের সাপ্তাহে ডেট আছে। নুসাইবা রাজি হয়। আসলে নুসাইবা কোন গ্যাপ রাখতে চাচ্ছে না। যাতে কেউ আসলে এখানে অস্বাভাবিক কিছু খুজে না পায়। এরপর দুই সাপ্তাহ পরের একটা ডেট নিয়ে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসে।

বের হয়ে সিড়ি দিয়ে নিচে নামে। দূরে ম্যানেজারের লোকদের সহ একটা গাড়ি দাঁড়ানো। ওর কাছে এসে দাঁড়ায়। নুসাইবা বলে আজকে এই গাড়িতে যাবে না। রিক্সা নিবে। ম্যানেজারের লোকগুলো অনুরোধ করে তাও নুসাইবা বলে রিক্সা নিবে আজকে। ম্যানেজারের লোকগুলো গাড়ি নিয়ে ওকে ফলো করে। রিক্সা থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। দেখে গাড়িটা স্লো গতিতে একটু দূর থেকে ফলো করছে। হাসি পায় নুসাইবার। এই প্রথম মনে হচ্ছে ঘটনার উপর ওর নিয়ন্ত্রণ আসছে। নুসাইবা কিছু একটা করছে ওদের অগোচরে। যেটা ওরা জানে না। তাই যতই ওরা ফলো করুক নুসাইবার মনে নিজের লাইফের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবার একটা আত্মবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে। গতকাল সন্ধ্যায় আবার মাহফুজের সাথে কথা হয়েছে। আবার বুয়ার ফোন দিয়ে। বুয়া একটু অবাক হয়েছে তবে কিছু বলে নি। কারণ কথা শেষ হলে কড়কড়ে একটা একশ টাকার নোট। আর বুয়া বিশ্বস্ত। নুসাইবা প্রতিবার কথা শেষে ফোন লগ ক্লিয়ার করে দেয়। আর বুয়া জানে বড়লোকদের কত কি রকম ব্যাপার স্যাপার থাকে। কার পরপুরুষের সাথে পিরিতি তো কার অন্য ধান্দা। নুসাইবা কে এতদিন এমন কিছু করতে দেখে নি। দেখলেও বুয়ার কিছু আসে যায় না। এই ম্যাডামের মত হেল্প আর কেউ করে না। এমনিতে একটু বকাঝকা দেয় তবে দিল পরিষ্কার। আর তার ফোন নিয়ে এমন কথা বলায় বুয়া একটু খুশিই হয়। কারণ জানে মানুষ যখন কোন গোপন কাজ করে তার যে স্বাক্ষী তাকে সব সময় সমজে চলে। তাই বুয়া কিছু না বলে নিজের মত কাজ করে। আর নুসাইবা মাহফুজের সাথে রুমে দরজা বন্ধ করে কথা বলে। মাহফুজের বুদ্ধিতে আজকে এই রিক্সা নিয়েছে। রিক্সাওয়ালা কে তাই সোজা রাস্তা দিয়ে না নিয়ে, নানা গলি দিয়ে ইচ্ছামত ঘুরিয়ে নিচ্ছে। ঘুরুক পিছন পিছন। মাহফুজ খালি বলে দিয়েছে তিন টা নির্দিষ্ট পয়েন্ট দিয়ে যেন রিক্সাকে ঘুরিয়ে আনে। আর কি জামা কাপড় পড়বে সেটাও শুনে নিয়েছে মাহফুজ। যাতে পরে চিনতে সুবিধা হয়। নুসাইবা জিজ্ঞেস করেছিল কেন? মাহফুজ বলল আপনি যত কম জানবেন তত ভাল ফুফু। ফুফু শব্দটার উপর একটা জোর দেয় মাহফুজ। রিক্সায় বসে ভাবে নুসাইবা, অন্য সময় হলে এই ফুফু শব্দটা এইভাবে বলার জন্য ঝাড়ি দিয়ে শেষ করে দিত মাহফুজ কে। কিন্তু এই বিপদের সময় আর কেউ নেই ওর পাশে। যে উদ্দ্যেশ করুক না কেন মাহফুজ এখন ওর একমাত্র মিত্র। আর মাহফুজের সাথে গত দুই দিনের কথায় মনে হচ্ছে মাহফুজ আসলেই উদবিগ্ন। সেটা কি সিনথিয়ার ফুফু বলে নাকি ওর প্রতি কোন টান আছে বলে সেটা শিওর না নুসাইবা। তবে এখন এসব নিয়ে ভাবার অত সময় নেই। আগে এইসব রাক্ষসদের খপ্পড় থেকে বের হতে হবে। নুসাইবার বিশ্বাস মাহফুজ কে সে কন্ট্রোল করতে পারবে। অবশ্য নুসাইবার মনের ভিতর আরেক কোণ থেকে কেউ বলে উঠে দুই দুইবার মাহফুজের কাছে কন্ট্রোল হারিয়েছে সে, এইবার কি আসলেই পারবে মাহফুজ কে কন্ট্রোল করতে। মনের ভিতর এইসব কথা কে উড়িয়ে দেয় নুসাইবা। এইসময় এত চিন্তা করার উপায় নেই। আসল প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করতে হবে। আর সেখানে মাহফুজ তার একমাত্র সহায়। প্ল্যান অনুযায়ী নির্দিষ্ট গলি গুলো দিয়ে রিক্সাগুলো কে ঘুরিয়ে আসল গন্তব্যে এসে পৌছায়। বাসার থেকে দুই মাইল দূরে সিংগারের একটা বড় শোরুম আছে। ওদের সব ধরণের পণ্যের জন্য। এখান থেকে আগে জিনিস কিনেছে। আরশাদ ট্যাক্স কমিশনার দেখে খুব খাতির করে দোকানের ম্যানেজার। প্ল্যানের সফল করবার জন্য পরবর্তী চালটা চালতে হবে এখান থেকেই। রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটায়। একটু দূরে ম্যানেজারদের মাইক্রোটা থেমেছে। ওর পিছন পিছন একটা সিএনজি এসে থেমেছে। ভিতর থেকে কেউ না নামলেও ভিতরের মুখটা দেখে বুক ধক করে উঠে নুসাইবার। আদিবা রহমানের রুমে বসা সেই পেসেন্ট। গাড়ির লোক যদি ম্যানেজারের হয় তাহলে সিএনজির লোক কে? মুন্সীর লোক? বুকের কাপুনি বাড়ে। তবে একটু আগের স্মৃতি মনে হয়। ও কি করছে কেন করছে এই লোক গুলো জানে না। এরা ওকে ফলো করলেও অন্ধের মত করছে। তাই আবার সাহস ফিরে পায়। প্ল্যানের পরের অংশ সফল করতে হবে ওকে। বুক ভরে একটা শ্বাস নেয়, এরপর দরজা ঠেলে সিংগারের শোরুমের ভিতর ঢুকে পড়ে।
Next page: Update 50
Previous page: Update 48