Chapter 04

রাতে লেপের মধ্যে শুয়ে শুয়ে সুখরঞ্জনের মনে পড়ে মাহিদিয়ার কথা।কতকাল ছেড়ে এসেছে তবু ভুলে থাকতে পারে না।রফিক মিঞার দেখাশুনার করার কথা,বাবা তার হাতে চাবি দিয়ে এসেছিলেন।ঠিকঠাক দেখাশুনা করছে তো। হয়তো গিয়ে দেখবে ঘরের কোনায় কোনায় ঝুল জমে আছে।চামচিকে বাসা বেধেছে।বিআরবি বলতে সবাই এক ডাকে চেনে।সবাই খুব সম্মান করতো।বিদ্যান পূজ্যতে সর্বত্র।বিআরবি আজ নেই।চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আর কোনো দিন কি দেশে ফেরা হবে?এইসব ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে।

সারা পাড়া ঘুমে অচেতন।গাছের পাতায় কুয়াশা জমতে থাকে।নিঝুম রাত পথ ঘাট শুনসান।নিশাচর পাখিরা শিকারের সন্ধানে ওত পেতে বসে আছে।সময়ের সাথে সাথে রাত পাতলা হতে থাকে।

বিজন পাল চোখ মেলে তাকালেন।জানলা দিয়ে ভোরের আলো বিছানায় এসে পড়েছে।পাশে প্রমীলা নেই।কাল রাতের কথা মনে পড়ল।

এরকম আগে কখনো হয়নি।দত্ত পুকুর থেকে ফিরে সামান্য কিছু কথা হয়েছে।তারপর শুয়ে যখন দেখল মেয়েটা ঘুমিয়ে কাদা।ধীরে ধীরে

কাপড় টেনে কোমর অবধি তুলতে কাচি মেরে পাশ ফিরে মুখ ঝামটা দিয়ে বলল,কি হচ্ছে কি?

করব?

আমার ভাল লাগছে না।

অবাক হল। আগে যখনই করেছে পা মেলে দিয়েছে।কোনো বাধা দেয়নি।ওকী তাকে সন্দেহ করছে?বাড়াটা ঠাটিয়ে রয়েছে। বিছানায় শুয়ে এ পাশ ওপাশ করতে থাকে।এই অবস্থায় ঘুম আসে।বুক অবধি লেপটা টেনে ঘুমোবার চেষ্টা করেন।অনেক রাতে ঘুম এসেছিল।অফিসের কথা মনে পড়তে উঠে বসলেন।অফিস গেলেই কিছু আয় হয়।অনেকে দু-এক টাকা গুজে দেয়।ফেলে দেওয়া যায় না তাই পকেটে ভরে রাখেন।এজন্য অফিস কামাই করতে ইচ্ছে হয় না।

গিরিবালা হেয়ার কিলিপ্টা দেখে খেয়াল হল কাল তাহলে এখানেই ফেলে রেখে গেছিল।তুলে নিয়ে মাথায় গুজলো।খোপায় ক্লিপ দেখে প্রমীলা ভাবেন,যা ভেবেছি তাই।বিছানার উপর কিভাবে কিলিপটা এল তার উত্তর পেয়ে গেলেন। কিন্তু কোনো কথা বললেন না।চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে চলে গেলেন।

প্রমীলা ঢুকে একটা টুল টেনে চায়ের কাপ রেখে বললেন,এইযে চা।

দেখো কেমন ভিজে বেড়ালের মত বসে আছে যেন কিছুই জানে না।একদিনের জন্য গেছে অমনি তর সয়না।বিজন পাল আড় চোখে দেখলেন কেমন থম্থমে মুখটা।কিছু না বললে তিনিও কিছু বলবেন না। বিজন চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিলেন।ঘড়ির দিকে দেখলেন আটটা বেজে গেছে।চা শেষ করে গামছা নিয়ে বাথরুমে ঢূকে গেলেন।প্রমীলা উঠে খুটিয়ে বিছানার চাদরটা দেখতে থাকেন।শেষে ঝি-চাকরের সঙ্গে ভেবে প্রমীলার কান্না পেয়ে যায়।

বাবার মৃত্যুর পর মা কোথাও যায় না।তাকে যাবার জন্য বলছে নাদিয়া অতদূর হতে এসে বলে গেল--।

মায়ের কথার অবাধ্য হবার সাধ্য সুখরঞ্জনের নেই।কিন্তু এদেশে কিছুই চেনে না কিভাবে যাবে ভেবে সমস্যায় পড়ল।বেরিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলে কিভাবে যেতে হয় জানা যায় কিনা ভাবে।

স্নান সেরে বিজন পাল বেরিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেশ বিন্যাস করছেন।গিরিবালার রান্না শেষে যাবার আগে উকি দিয়ে বলল,বোউদি আমি আসছি।

এক মিনিট দাড়া।

প্রমিলা উঠে আলমারি খুলে টাকা বের করলেন।বিজন পাল আড় চোখে দেখতে থাকেন।টাকা গুনে গিরিবালার হাতে দিল।

এখনো তো মাস শেষ হয়নি।গিরিবালা অবাক হয়ে বলল।

তোকে কাল থেকে আসতে হবে না।

কথাটা ঠিক শুনেছে তো।গিরিবাল বলল,কি বললেন বৌদি?

তোর আসার দরকার নেই।

নোক পেয়েছেন?কে মাস্টেরের বউ?

তাতে তোর দরকার কি?

গিরিবালা একবার বিজন পালের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল।

ওকে ছাড়িয়ে দিলে রান্না করবে কে?

খুব কষ্ট হচ্ছে?

আমার কষ্ট হবে কেন?তোমাকেই রান্না করতে হবে।

আয় খুকী।মেয়েকে নিয়ে বাথরুমে নিয়ে স্নান করাতে থাকেন।আজ কলেজ নেই তবু একসঙ্গে খেয়ে নিক।অন্যদিন ও বাবার সঙ্গে বের হয়।ওকে কলেজে দিয়ে অফিস চলে যায়।স্নান করিয়ে মাথা মুছে বললেন,বাবাকে নিয়ে খেতে এসো।

প্রমীলা রান্না ঘরে চলে গেলেন।মাস্টারের বউ কথাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করেন মনে মনে।নতুন কোনো বিপদ হবে নাতো।চোখে চোখে রাখলে কি বিপদ হবে।একটা থালায় ভাত বাড়তে থাকেন।

বাইরে বেশ ঝলমলে রোদ।সুখ রঞ্জন সোয়েটার খুলে রেখে বেরিয়ে পড়ল।বটতলায় এখন ওদের পাওয়া যাবে।সুখ রঞ্জন বটতলার দিকে হাটতে থাকে।বন্ধু এত দূর থেকে এসে নেমন্তন্ন করে গেল এটাই একমাত্র কারন নয়।সুখরঞ্জন জানে কেন এত পীরাপিড়ি করছে মা।বিয়ে বাড়ি গিয়ে ছেলেটা একটু ভালমন্দ খেয়ে আসুক সেটাই মায়ের উদ্দেশ্য।মায়েরা কেন এত ভাল হয়?চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।দূর থেকে তাপসকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কিরে কোথায় চললি?

বটতলায় যাচ্ছিলাম তোকে দেখে দাড়িয়েছি।

চল।দুজনে হাটতে শুরু করে।

হাটতে হাটতে কিছুটা যেতে সুখরঞ্জন বলল,তাপস তুই বৈদ্যবাটি চিনিস?

বৈদ্যবাটি হুগলীতে কেন চিনবো না।হঠাৎ বৈদ্যবাটি?

কাল একটা নেমন্তন্ন আছে।আমি তো এদিককার কিছু চিনি না।

হুম পৌষমাস হল বিয়ের সিজিন।এক্টু ভেবে তাপস বলল,বৈদ্যবাটি যাবি তাইতো?অনেকভাবেই যাওয়া যায়।তবে আমার মতে বাস স্ট্যাণ্ডে গিয়ে নৈহাটি পর্যন্ত বাসে--ধর ঘণ্টা খানেকের পথ।তারপর ট্রেনে ব্যাণ্ডেল।ঘন ঘন ট্রেন কাউকে বৈদ্যবাটি জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে।

তাপসের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে একবার ঝালাই করে নিল।বাসে নৈহাটী তারপর ব্যাণ্ডেল সেখান থেকে বৈদ্যবাটি।বটতলার কাছাকাছি এসে তাপস বলল,তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব কিছু মনে করবি নাতো?

তাপস এত ভণিতা করছে কেন?হেসে বলল,মনে করার কি আছে?

না থাক।

থাকবে কেন,বলনা।

একটু ইতস্তত করে তাপস বলল,কথাটা সীমাকে নিয়ে।

সীমাকে নিয়ে কথা সে কেন মনে করবে।সীমার উপর তাপসের একটু নজর আছে জানে।কিন্তু তাপস কি বলতে চায় অনুমান করার চেষ্টা করে।

বটতলা থেকে হাক পাড়ল,কিরে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?

চল ওরা ডাকাডাকি করছে।পরে বলবো।

দুজনে গিয়ে আড্ডায় সামিল হল।কদিন পর রেজাল্ট বেরোবার কথা সেই সব নিয়ে আলোচনা চলছিল।রমেন বলল,কিরে এত দেরী করলি?এক্টু আগে এলে দেখা হতো।

ছাড়তো ফালতু কথা।

সুখ আড়চোখে তাপসকে দেখে,রমেন মনে হয় সীমার কথা বলল।

বিজন পাল খেয়ে বেরিয়ে গেলে প্রমীলা খেতে বসেন।রাগের মাথায় গিরিকে তাড়িয়ে ভাবছে এখন কি করবে।তার পক্ষে হাড়ি ঠেলা সম্ভব নয়।মাস্টারের বউয়ের কথা আগেও শুনেছেন,রান্নার হাত ভালই।কত টাকা চাইবে কে জানে।কিন্তু লোক তো একটা চাই।গিরিকে তাড়াতে বিজন খচে গেছে ও বেশী গরজ দেখাবে না।খেয়ে দেয়ে একবার বেরোবে ভাবেন।

বেলা বাড়তে থাকে এক সময় আড্ডা ভেঙ্গে যায়।সুখকে নিয়ে তাপস উঠে পড়ল।সুখ বুঝতে পারে তাপস সেই প্রসঙ্গ তুলবে।সীমার কথা কি বলবে।

সীমাকে তোর কেমন লাগে?

প্রশ্নটা দুম করে এসে লাগে।সুখ বলল,কেমন আবার ভালই।

হু-উ-ম জানতাম।তুই এখনো মানুষ চিনিস নি।

এর মধ্যে চেনাচিনির কি হল সুখ বুঝতে পারে না।

তোর মাকে নিয়ে কি বলছিল জানিস?

মায়ের কথা বলতে সুখ চমকে ওঠে।

মাসীমা লোকের বাড়ী রান্না করে।

সুখর মনটা শান্ত হয় বলে,মা তো লোকের বাড়ী রান্না করে তাতে কি হয়েছে?

ও নিজেকে কি ভাবে?

যাই ভাবুক তা নিয়ে আমার ভাবার সময় নেই।

শোন সুখ তুই ওকে পাত্তা দিবি না।

তাপস বাড়ির দিকে চলে গেলে সুখ একলা হয়।মা মনে হয় এতক্ষনে বাসায় ফিরে এসেছে।সীমা যদি বলে থাকে ভুল তো বলেনি।সীমা কি সত্যিই বলেছে?কারো বাড়ি রান্না করলে ছোটো হয়ে যায়? বাড়ীর কাছাকাছি আসতে নজরে পড়ে মা একজন মহিলার সঙ্গে কথা বলছে।কাছে এসে চিনতে পারে পালবাবুর বঊ।

তুমি বলো কত টাকা চাও?প্রমীলা বললেন।

কথাটা কানে যেতে মাথার মধ্যে ঝিন ঝিন করে ওঠে।সুখ বলল,উনি আপনার চেয়ে বয়সে বড়।ভদ্রভাবে কথা বলুন।

অভদ্রভাবে কি বললাম?অবাক চোখে তাকালেন প্রমীলা।

মনু তুই ভিতরে যা।কঠিণ গলায় বললেন সুমনা।

সুখ ভিতরে চলে গেল।সুমনা বললেন,কিছু মনে করবেন না।দেখুন টাকার জন্য নয় আমার হাতে যা কাজ আমি পারবো না।

তুমি পারবে না?

না ভাই পারলে আপনাকে এত বলতে হতো না।

সুমনা ঘরে ঢুকে দেখলেন মনু গোজ হয়ে বসে আছে,মনে মনে হাসলেন।

তুমি আপনি বলছো আর উনি তোমাকে তুমি-তুমি বলে যাচ্ছে।

চান করে আয় ভাত দিচ্ছি।ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,এত মাথা গরম করতে নেই।কাক কাকের মতই ডাকবে কোকিলের ডাক আশা করলে হতাশ হতে হবে।

সুখ চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকালো,কি সুন্দর কথা।যে যেমন তার ব্যবহারও তেমন।অধ্যাপকের বউয়ের মতো কথা।

সুমনা কাজে বেরিয়েছেন।বিছানায় শুয়ে লাইব্রেরী থেকে আনা বইটায় চোখ বোলাতে থাকে সুখরঞ্জন।বারট্রাণ্ড রাশেলের ইম্প্যাক্ট অফ সোশাল সায়েন্স।কাল জামা প্যাণ্ট কেচে মাড় দিয়ে রেখেছে।মা ফিরে উনুনে আগুন দিলে ওগুলো ইস্ত্রী করতে হবে। গরম বস্ত্র বলতে একটা হাফ হাতা সোয়েটার।একটা নস্যি রঙের আলোয়ান আছে সেটা গায়ে দিয়ে বিয়ে বাড়ি যাওয়া যায় না।একবার মনে হল আলোয়ানটা কাগজে মুড়ে নিয়ে যাবে।কেন না রাতের দিকে ঠাণ্ডা পড়তে পারে।আবার ভাবল এত দূরের জার্নি চাদর বয়ে নিয়ে যাওয়া এক ঝঞ্ঝাট।তাপস যা বলল তাতে মনে হয় যেতে আসতে চার ঘণ্টা আর খাওয়া দাওয়া আধ ঘণ্টা।যদি ছটায় বের হয় তাহলে ফিরতে ফিরতে এগারো সাড়ে এগারোটা বেজে যাবে।

. বিয়ে বাড়ীতে বিরিয়ানি হবেই। মালাই কোফতা সিরনি কত কি পদ হয় সব নাম জানে না।অনেককাল ভাল মন্দ খাওয়া হয়নি। বেলা হল মা এখনো ফিরল না।কখন রান্না করবে কখন খাবে কখন জামা প্যাণ্ট ইস্ত্রী করবে চিন্তা হয়। কালকের কথা মনে পড়তে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।মাকে যেমন নিরীহ মনে হয় তেমন নয়।পালবাবুর বউকে ভালই জব্দ করেছে।তুমি-তুমি করছে শুনে এমন রাগ উঠেছিল মহিলা না হলে এক চড় কষিয়ে দিত।বইটা রেখে উঠে বসল।বাইরে বেরিয়ে রাস্তার এদিক ওদিক দেখতে থাকে।

ওই তো মা আসছে।বাজারের দিক থেকে কেন ভ্রু কুচকে যায়।হাতে মনে হচ্ছে কিসের একটা প্যাকেট। কাছে আসতে জিজ্ঞেস করে,এত দেরী করলে, হাতে কি?

সুমনা প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,বরেনবাবুর সঙ্গে দেখা হল তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল?

প্যাকেট খুলে দেখে একটা বেড কভার।মায়ের দিকে তাকাতে সুমনা বললেন,কিছু তো নিয়ে যেতে হয়।খালি হাতে যাবি?

মার সব দিকে খেয়াল তার একথা মনেই হয়নি।এই বেড কভার নিয়ে যাবার কথা ভেবে বিরক্ত হয়।ঝাড়া হাত পা যাবে বেড কভার বগল দাবা করে চলো।

সুমনা রান্না ঘরে গিয়ে উনুনে আগুন দিলেন।

বরেনদা লাইব্রেরীতে বসেন।কিছু মানুষ থাকে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার মতো।বরেনদা সেই রকম।অফিস থেকে ফিরে লাইব্রেরিতে বসেন।বলতে গেলে বরেনদার জন্যই টিকে আছে এই লাইব্রেরী।আট থেকে আশি সকলেই বলে বরেনদা।সেও বরেনদাই বলে।বরেনদা বাবার কাছে আসতেন মাকে বলতেন বৌদি।সেই হিসেবে বরেনদাকে কাকা বলার কথা।বরেনদা একদিন বলেছিলেন,হ্যারে মনু তুই কেবল প্রবন্ধের বই পড়িস কবিতা পড়তে ভালো লাগে না?

প্রবন্ধে অনেক বিষয় জানা যায়।

বরেন ভৌমিক হাসলেন।চিবুকে হাত দিয়ে কি যেন ভাবলেন তারপর বললেন,প্রবন্ধ যদি দুধ হয় কবিতা জানবি মাখন।বিভিন্ন জ্ঞানের নির্যাস কবিতায় ধরা থাকে।সুনির্মল বসুর একটা কবিতে খুব সিমপল শোন,

আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
উদার হতে ভাই রে;
কর্মী হবার মন্ত্র আমি
বায়ুর পাই রে।
পাহাড় শিখায় তাহার সমান
হই যেন ভাই মৌন-মহান্,
খোলা মাঠের উপদেশে—
দিল্-খোলা হই তাই রে।
..বিশ্ব-জোড়া পাঠশালা মোর,
সবার আমি ছাত্র,
কিরে কেমন লাগল?
বরেনদা একটু আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েছেন।সবার সঙ্গে সব কথা বলা যায় না,মনের মত শ্রোতা পেলে সকলেই আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ে।বললাম, বাঃ দারুণ!
এই প্রকৃতি আমাদের পাঠশালা চোখ মেলে গ্রহণ করতে পারলে এখান থেকেই তুই শিখতে পারবি অনেক কিছু।
বরেনদার সঙ্গে কথা বলতে আমারও ভাল লাগছে।কিন্তু বরেনদার গল্প করার সময় কোথা।পাঠকরা আসছে ফরমাস মতো তাদের বই দিতে হচ্ছে।
হচ্ছে।বই জমা নিতে হচ্ছে।পাঠকদের বরেনদা খুব খাতির করেন।পাঠকরাই লাইব্রেরীর প্রাণ।
খাওয়া দাওয়া শেষ হতে বেলা আড়াইটে বেজে গেল।সুখ রঞ্জন প্রস্তুত হতে থাকে।একটু আগে ইস্ত্রি করা পাট ভাঙ্গা জামা প্যাণ্ট পরল।
সোয়েটারটা হাতে ঝুলিয়ে কয়েক পলক দেখে কাধে রাখল।পাচটা বাজে দেরী না করে ভাবল সকাল সকাল বেরোনোই ভাল।মায়ের কাছে গিয়ে বলল,সাবধানে থেকো।
আমার পাহারা দেবার লোক আছে।তুই সাবধানে যাস।মিনুকে আমার কথা বলিস।
সুখরঞ্জন বিহবল দৃষ্টিতে মাকে দেখে।পাহারা দেবার কাউকে দেখেছে বলে মনে পড়ল না।
তোমাকে পাহারা দেয় কে?
কেন তোর বাবা।সারাক্ষন আমি তাকে পাশে পাশে দেখি।
প্রণাম করার ছলে চোখের জল লুকায়।সুমনা ছেলের চিবুক ছুয়ে আশির্বাদ করলেন।বিচিত্র এই বাঙালী মায়েরা কি গভীর বিশ্বাস নিয়ে বেচে আছেন।
বাস স্ট্যাণ্ডে পৌছে জিজ্ঞেস করে বাসে উঠল।লোকজন তেমন নেই পছন্দ মত জানলার ধারে একটা আসন দখল করে বসল।সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে।জানলা দিয়ে উপচে পড়ছে মিঠেল রোদ।দেখতে দেখতে বাস ভরে গেল।একটা ঝিমুনির ভাব আসছে।সুখরঞ্জন চোখ বুজে ঝিমোতে থাকে হকারের উপদ্রব এড়াতে।এক্টু পরেই বাস নড়ে উঠল।সুখরঞ্জন চোখ মেলে বাইরের দিকে তাকায়।এদেশে এসে এই প্রথম বাসে চড়ার অভিজ্ঞতা।কিছুক্ষনের মধ্যে বাস লোকালয় ছেড়ে ফাকা রাস্তা ধরে।দুধারে দিগন্ত ধান ক্ষেত।হাওয়ার আকুলি বিকুলিতে দুলছে।শীতের দিন ছোটো হয় মুহূর্তে ম্লান হয়ে এল চরাচর।বাস ছুটে চলেছে তীব্র বেগে।মাঝে মাঝে থামছে লোক নামছে উঠছে তার বেশী।নৈহাটি কতদূর বসে থেকে ক্লান্তি এসে গেছে।টিকিট কাটার সময় কণ্ডাক্টরকে বলেছিল নৈহাটি নামিয়ে দিতে।ভীড়ে কণ্ডাকটরকে দেখছে না।তার মনে আছে কিনা কে জানে।পাশে বসা ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতে বললেন,এইতো সামনে।
বাস থামতে কণ্ডাকটর হাক পাড়ে টিশন টিশন।
সুখরঞ্জন তড়াক করে উঠে দাড়ালো।
বাস থেকে নেমে সুখরঞ্জন টের পেল বাতাসে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব।মাথা গলিয়ে সোয়েটারটা গায়ে দিল।ফুলহাতা সোয়েটার হলে ভাল হত।একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করে স্টেশনের রাস্তা ধরল।

একটু আগে একটা ট্রেন চলে গেল।প্লাট ফর্ম প্রায় ফাকা। টিকিট কেটে প্লাট ফরমে ঢুকে দেখল একটা বেঞ্চে হাফ হাতা সোয়েটার গায়ে মধ্য বয়সী এক ভদ্রলোক বসে আছে একা।পায়ে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল।এক্টু দূরত্ব বাচিয়ে বেঞ্চে বসল।ভদ্রলোক আড়চোখে তাকে একাবার দেখলেন।কোলের উপর বেড কভারের প্যাকেট সুখরঞ্জন ভাবে ভদ্রলোককে ট্রেনের কথা জিজ্ঞেস করবে কিনা।ভদ্রলোক এমন উদাসভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে ভরসা হচ্ছে না।

ভাইসাব আপনের কাছে ম্যাচিস আছে?

সুখরঞ্জন তাকিয়ে দেখল ভদ্রলোক তাকেই বলছেন।

আমি সিগারেট খাই না।

ভেরি গুড।টোবাকো ইজ ইঞ্জুরিয়াস টু দি হেলথ।

জ্ঞানপাপী।সব জানে তবু খাওয়া চাই।

আপনি ভাবছেন জেনে শুনে আমি খাই কেন?

সুখ রঞ্জন চমকে উঠল সেতো একথা বলেনি।লোকটির প্রতি কৌতূহল বাড়ে।

অনেক চেষ্টা করেছি ছাড়তে পারিনি।

বড্ড বেশি বকে ভদ্রলোক।কে তোমার কাছে ইতিহাস শুনতে চাইছে।

আপনি ভাবছেন আমি বেশী কথা বলি।

বিস্ময়ের সীমা থাকে না ।ভদ্রলোক বলতে থাকেন,সবাই এরকম বলে।আসলে কি জানেন কথা বলি নিজের স্বার্থে।যত কথা বলি তত নিজেকে হালকা মনে হয়।তা ভাই যাবেন কই?

সুখরঞ্জন উৎসাহিত হয়ে বলল,বৈদ্যবাটি।

ভদ্রলোক ভ্রু কুচকে তাকে দেখে বলল,ব্যাণ্ডেল লোকাল ধরে তারপর বৈদ্যবাটি।যাক একজন সঙ্গী পাওয়া গেল।আপনি তো আমার সহযাত্রী।

আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ আমাকে তুমি বলতে পারেন।

বৈদ্যবাটি কার বাসায় যাবে?

সুখরঞ্জন পকেট থেকে কার্ড বের করে দেখাতে ভদ্রলোক বললেন, চাপদানী স্পন্দন?চল তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।

আপনার ওখানে নেমন্তন্ন আছে?

না আমি চাপদানীতে থাকি নেমন্তন্ন নেই।শকিবুল ইমাম আমার নাম বললে ওরা চিনবে।

আমার নাম সুখদারঞ্জন বসু।

কোনো চিন্তা কোরোনা একেবারে জায়গামত পৌছে দেব।এক্টু বোসো এইটা ধরিয়ে আনি।

ইমামসাহেব উঠে চলে গেলেন।ভদ্রলোক . অথচ এতক্ষন কথা বলে বুঝতেই পারি নি।কি সুন্দর অমায়িক ব্যবহার। তাহলে মানুষে মানুষে এত ভেদাভেদ হানাহানি কেন।দুটি মেয়ে সম্ভবত কলেজ পড়ুয়া পাশে এসে বসল।বেঞ্চে চারজন বসা যায়,গায়ে গা লেগে যায়।ইমাম সাহেবের বসার জায়গা নেই বিরক্ত হয় সুখদা।

যাইরে বাড়ী যাই সন্ধ্যে হয়ে এল।

আরেকটু বোস না।কাছেই তো বাড়ি।

ওদের কথা কানে যেতে বুঝতে পারে এরা ট্রেনের প্যাসেঞ্জার নয়।আড্ডা দিতে এসেছে।ইমামসাহেব সাহেব আসছেন।সুখ উঠে এগিয়ে যাবে কিনা ভাবছে।একটি মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,আসিরে কাল কলেজে দেখা হবে।ইমামসাহেব এসে বসতে অন্য মেয়েটি উঠে ওদিকে চলে গেল।ইমাম সাহেব সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন,এবার আমাদের উঠতে হবে।গাড়ী দিয়েছে তিন নম্বরে।

প্লাট ফর্ম এক আজিব জায়গা।কতরকম মানুষ আসে প্লাট ফরমে।কেউ আসে ট্রেন ধরতে কোথাও যাবার জন্য কেউ আসে বসে গল্প গুজব করতে রাতে অন্য চেহারা।এইসব বেঞ্চগুলো তখন ভবঘুরেদের দখলে।কেউ ট্রেন ধরতে না পেরে বেঞ্চে শুয়ে রাত কাটিয়ে দেয়।

চলো তিন নম্বরে।

ইমাম সাহেবের সঙ্গে চলতে শুরু করি।ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়ে ভালই হয়েছে।দু নম্বর তিন নম্বর জানা ছিল না।তিন নম্বরে একটা ফাকা গাড়ী দাঁড়িয়ে ছিল।ইমাম সাহেবের কথা মতো উঠে জানলার ধারে দুজনে সামনা সামনি বসলাম।মানুষ উঠছে কেঊ উঠে একটা রুমাল রেখে আবার নেমে গেল।

তুমি কোথা থেকে আসছো?

বনগাঁ গোপাল নগর থেকে বাসে এলাম।

বাসে কেন?

আমি এখানকার কিছুই চিনি না।আমার এক বন্ধু বলল, বাসে গেলেই সুবিধে।

তুমি এখান থেকে ট্রেনে রাণাঘাট গিয়ে ওখান থেকে বনগাঁর ট্রেন ধরে গেলে কমসে কম আধ ঘণ্টার সাশ্রয় হবে।আজই তো ফিরবে?

হ্যা বাড়ীতে মা একা আছে।

বেশী রাত কোরোনা তাহলে প্লাটফরমে রাত কাটাতে হবে।

মৃদু হাসলাম।ভদ্রলোক বেশ কথা বলেন।

বিয়ে বাড়িতে খাওয়ার একটা মজা আছে।বিনি পয়সায় দামী দামী খাবার প্রতিদিনের এক ঘেয়েমী থেকে একটু আলাদা আর কি।

দুড়দাড় করে লোক ওঠা শুরু হতেই ইমামসাহেব বললেন,এবার ছাড়বে।

ঠিক ট্রেন ছেড়ে দিল।দূরত্ব বেশী নয় দুটো স্টেশন পর ব্যণ্ডেল জংশন।ট্রেন থেকে নেমেই দেখলাম একটা ট্রেন ছাড়বে ছাড়বে করছে।ইমাসাহেবের সঙ্গে ছুটে সেই ট্রেনে চেপে বসলাম।

ইমামসাহেব সঙ্গী না হলে খুব মুশকিলে পড়তাম।বৈদ্যবাটি নেমে মনে হল আলোয়ানটা নিয়ে এলেই ভালো করতাম।জাকিয়ে শীত পড়েছে।

এবার কি বাসে উঠতে হবে?

না না হাটাপথ দশ মিনিট,চলো দেখিয়ে দেবো।

দুজনে হাটতে শুরু করি কিছুক্ষন পর দূরে একটা আলো ঝলমল বাড়ি দেখিয়ে বললেন,ঐ হচ্ছে স্পন্দন।

যাবেন না?

এখন কটা বাজে।

দশটা বাজতে মিনিট পনেরো হবে।ঘড়ি দেখে বললেন।

আমার অন্য পথ।ইমাম সাহেবকে পিছনে রেখে দ্রুত পা চালাই।গিয়েই খেতে বসে যেতে হবে।মাসী ছাড়া কাউকে চিনি না।মাসীকেই বা পাবো কোথায়?এরক দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে এগোতে থাকি।​
Next page: Chapter 05
Previous page: Chapter 03