Chapter 29

পানুবাবুকে নিয়ে হোটেল থেকে খেয়েদেয়ে কলতানে ফিরে খাটের উপর বিছানা দেখে ভাবে কতদিন এরকম বিছানায় শোওয়া হয়না।কথা বলে বুঝেছে পানুবাবু এখানেই থাকবেন পাঞ্চালীর কম্পাউণ্ডার হিসেবে।সকালে মামণিকে নিয়ে পৌছাবে পাঞ্চালী।সঙ্গে পারুলদিও আসছে।পাঞ্চালীর কথা মনে হতে কেমন একটা হীনমন্যতাবোধ তাকে গ্রাস করে।পাঞ্চালীর সঙ্গে সেকী প্রতারনতা করছে?কেন যে মোমোর কথায় রাজী হতে গেল।মোমো যা করেছে নিজের জন্য মনুর ভালর জন্য করেছে।মোমোকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।একা একা কি করছে কে জানে।অবশ্য ঈশানী আছে এখন একেবারে একা নয়।মোমোর কথা ভাবতে ভাবত ঘুমিয়ে পড়ল সুখ।

তুহীন বেরা দেশে গেছে।কলকাতায় কাজ থাকলেই বর্ধমানে মায়ের কাছে যায়।আজ রাত ফিরবে না।কলকাতায় কাজ সেরে কাল ফিরবে।রান্নার মেয়ে মণিকা পাশের ঘরে শুয়েছে সীনন্তিনী আজ একা।অবশ্য এরকম আজ প্রথম তা নয় মাসে অন্তত একবার বর্ধমানে যাবেই মায়ের সঙ্গে দেখা করতে।তাছাড়া আইবুড়ো এক বোন আছে।লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন সীমন্তিনী।এসআরবি ছেলেটাকে ভাল লেগেছে।চুপচাপ থাকে কিন্তু কথায় ধার আছে। এনসিএসকে বেশ জব্দ করেছে।বিবাহিত শুনে অবাক লেগেছে।চাল চলন দেখে মনে হয়নি বিবাহিত।কেমন ভবঘুরে হাবভাব।নারী সংসর্গে এলে পুরুষদের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় এসআরবির মধ্যে সেরকম কিছু নজরে পড়েনি।বিবাহিত জানলে অত কথা বলতেন না। নিজেকে প্রবোধ দিলেন বলেছেন তো কি হয়েছে বানিয়ে তো বলেন নি।

ট্রেনে উঠেই মামণি পারুলদি বিছানা করে শুয়ে পড়েছে।বর্ধনান পেরোতেই ঘুমে কাদা।পাঞ্চালীর ট্রেনে ঘুম হয়না।জানলার ধারে বসে দৃষ্টি মেলে দিয়েছে বাইরে।জমাট অন্ধকারে দূরে টিপটিপ জ্বলছে আলো।দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে জ্যোতস্না উপচে পড়ছে। চোখের সামনে হতে সরে সরে যাচ্ছে এক একটা গ্রাম।নিরীহ গোয়ার গোবিন্দ ছেলেটাকে প্রথম দেখেই ভাল লেগে গেছিল।নানাভাবে বোঝালেও বলদটা বোঝেনি।তারপর কলকাতায় পড়তে এসে প্রায় ভুলতে বসেছিল।গোপাল নগরে ফিরে এসে সুব শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিল।কলকাতায় মেসে গিয়েও হদিশ পায়নি।ওকে যে ফিরে পাবে ভাবেই নি।কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই মেলতে পারছে না ঐ রকম হাদাভোদা ছেলে এতসব জানল কি করে?মেয়েদের সামনে যে দরদর করে ঘামে তার তো এতসব জানার কথা নয়।পাঞ্চালী জানে মিথ্যে বলার ছেলে ও নয়। সম্পর্কটা একটু সহজ হোক তারপর জিজ্ঞেস করা যাবে। গোপাল নগর থেকে কোথায় গেছিল মোমোর সঙ্গেই বা কিভাবে যোগাযোগ।একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে সব কিছুকে সহজভাবে মেনে নিতে পারে। একের পর এক ঝড় ঝাপটা তো কম যাযনি তারপর ওর মামা যে ব্যবহার করেছে অন্য কেউ হলে ভেঙ্গে পড়তো।কিন্তু ও শেষ পর্যন্ত মাস্টার্স করেছে শুধু না ভালো রেজাল্ট করেছে। ট্রেনের হুইশল শোনা যাচ্ছে সামনে কোনো স্টেশন আসছে সম্ভবত।বাড়ী থেকে বেরোবার সময় এমন একটা খারাপ ঘটনা ঘটলো।যদিও পাঞ্চালী এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করেনা তবু মনটা কেমন খুত করে।ওদিকে খারাপ কিছু ঘটেনি তো?পাঞ্চালী বাটন টিপে মোবাইল কানে লাগায়।

মোবাইলের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল।হাতড়ে হাতড়ে মোবাইল চোখের সামনে ধরে সুহ দেখি,সাতটা বাজতে চলেছে।বিছানায় উঠে বসে মোবাইল কনে লাগিয়ে তন্দ্রা জড়িত গলায় বলল,হ্যালো ?

ঘুম ভেঙ্গেছে?

হ্যা বলো।

আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আমাদের গাড়ী ঢুকে যাবে।

হ্যা জানি।

মালপত্তর সব গুছিয়ে রেখেছো?

হ্যা।শোনো একটা গ্যারাজ আছে একবারে রাস্তার উপর--।

গাড়ী এখনই কিনছি না।

গাড়ীর কথা বলছি না,ঐটা তোমার চেম্বার হতে পারে ।পান্নাবাবুও বলছিলেন--।

ঠিক আছে আগে পৌছাই।কাকু কি করছে?

পাশের ঘরে আছে তুমি কথা বলবে,ডাকবো?

না না এখন থাক।

পাশের ঘরে গিয়ে দেখল পান্নাবাবু উঠে বসে বিড়ি ধরিয়েছেন তাকে দেখে ফেলে দিয়ে বলেন,কিছু বলবেন?

ওদের তো আসার সময় হয়ে গেল।আমরা স্নান খাওয়া সেরে নিই?

ডাক্তার দিদি বলেছেন এখানে এসে রান্না হবে।আপনি স্নানটা সেরে নিন।

পাঞ্চালী পান্নাবাবুকে বললেও তাকে এসব বলার প্রয়োজন মনে করেনি।একটা তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢূকে গেল।

কতবড় ডাক্তারের মেয়ে পাঞ্চালী নিজেও ডাক্তার অভিজাত পরিবার।লোকে বলে পাপ কখনো চাপা থাকে না। যেদিন তার স্বরূপ জানতে পারবে পাঞ্চালীর মুখের অবস্থা কেমন হবে ভেবে সুখ শিউরে ওঠে।মোমোকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল তার কোনো দোষ নেই বলে এড়িয়ে যাওয়া যায়না।এইভাবে সম্পর্ক টেনে নিয়ে যাওয়া সমীচীন হচ্ছে না। বাথরুম হতে বেরিয়ে দেখল পান্না বাবু স্নান করে একেবারে রেডি।সুখও তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নিল।সময় হয়ে গেছে ওরা কিছুই চেনে না।শিলিগুড়ী যাবার জন্য একটা রিক্সায় উঠে বসল।

কাঞ্চনকন্যা ঢুকছে খবর হয়েছে।সুখ একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে।কদিন ধরে মোমোর কথা খুব মনে পড়ছে।কার জন্য কোন পথ নির্ধারিত কে বলতে পারে।মোমোর সঙ্গে তার জীবন এভাবে জড়িয়ে যাবে কোনোদিন ভেবেছিল।গাড়ী ঢুকছে মোবাইল বেজে উঠতে বিরক্ত হয়ে বাটন টিপে কানে লাগিয়ে বলল,হ্যালো?

সাহেব বলছেন?

আপনি কে বলছেন?

আমি ঈশানী--।

নামটা শুনে উত্তেজিত হয়ে ভাবে ওকি নিজেই ফোন করেছে নাকি মোমোর কথায় ফোন করেছে?বলল,কেমন আছেন?

ভাল না।ম্যাডামের এক্সিডেন হয়েছে--।

এ্যাক্সিডেণ্ট মানে কোথায়?

কলেজ থেকে ফেরার সময় বাস থেকে নামতে গিয়ে--।

কলেজ থেকে ফেরার সময়--এখন তো কলেজে যাওয়ার সময় হয়নি।জিজ্ঞেস করল,কখন?

কাল বিকেলে?

আপনি এখন বলছেন।সুখ উত্তেজিত।

আমি অনেকবার চেষ্টা করিছি--।ফোন কেটে গেল।

ট্রেন থামতে প্রচুর মাল পত্তর নামানো হল।পারুলকে ধরে নামলেন পিয়ালী মিত্র।সুখকে দেখে পাঞ্চালী বেশ বিরক্ত।স্তম্ভের মত কেমন দাঁড়িয়ে আছে।কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,কি ব্যাপার?

খারাপ খবর আছে।নিষ্প্রাণ গলায় বলল সুখ।

কি খারাপ খবর?

তোমার পিসি এ্যাক্সিডেণ্ট করেছে।

মোমো?মামণিকে এখন কিছু বোলোনা।

আমাকে কলকাতায় যেতে হবে।আমাকে কিছু টাকা দেবে?

পাঞ্চালীর অবাক লাগে তার পিসি অথচ ওর গরজ বেশি। সমস্ত ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগে।একবার ভাবল বলে তুমি গিয়ে কি করবে।কিছু নাবলে

পান্নাবাবুর ডাক শুনে পাঞ্চালী এগিয়ে গেল।একটা ট্রেকারে মালপত্তর তোলা হয়েছে।মামণি ড্রাইভারের পাশে বসেছে।পারুলদি পিছনে।পাঞ্চালী বলল,কাকু আপনারা চলে যান।আমি বাজার করে যাচ্ছি।

ঘোরাঘুরি করে খোজ নিয়ে তিস্তা-তোর্ষায় জানা গেল টিকিট আছে।গাড়ী পৌনে চারটেয়।পাঞ্চালী দুটো টিকিট কাটলো।সুখ জিজ্ঞেস করে তুমিও যাবে?

একতলা হলেও বাড়ী দেখে পিয়ালী মিত্রের খুব পছন্দ হয়েছে।ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকেন বেশ প্রশস্ত ঘরগুলো সামনে গ্রিল ঘেরা বারান্দা পিছনে এক চিলতে বাগান।বাড়ীওলা বিদেশে থাকে পুরো বাড়ীটাই তাদের।পারুল রান্না ঘরে গোছ গাছ করছে।পান্নাবাবু বাজার থেকে আসলেই রান্না শুরু করে দেবে।পলির কাছে দীপার খবর শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।পিয়ালী মিত্র জিজ্ঞেস করলেন,তোকে কে বলল?

রান্নার মহিলা ফোন করেছিল।

কি করে এ্যাক্সিডেণ্ট হল?

অত জানিনা ওকে ফোন করেছিল।

একা একা তুই যাবি এতটা জার্নি করে এলি--সঙ্গে পানুবাবুকেও নিয়ে যা।

তোমার বাচ্চু সোনাও যাবে।

তাহলে ত ভালই হল এখন ওরই তো দায়িত্ব তোর দেখাশোনা করার।

এই ননদের সঙ্গে বেশী ঘনিষ্ঠতা ছিলনা।বিয়ের কিছুকাল পরে শ্বশুরমাশায়ের অবাধ্য হয়ে বাড়ী ছেড়ে কলকাতায় চাকরি করতে বাড়ী ছেড়েছিল।তাহলেও তার যাওয়া উচিত।পিয়ালী বললেন,আমার শরীরটা ভাল নেই নাহলে--।

এতলোক যাবার দরকার কি?আমরা তো যাচ্ছি।

ঠিক আছে গিয়েই খবর দিবি কেমন আছে দীপা?মনুর কলেজ নেই?

ও কলেজে যাবেনা।

বারান্দায় বসে আছে সুখ।কি হচ্ছে কলকাতায় মোমোর দেখাশুনা কেইবা করছে।এইজন্য কলকাতা ছেড়ে তার আসার ইচ্ছে ছিল না।মোমোর ইচ্ছেতেই সে আজ এতদূরে কলেজের চাকরি নিয়ে এসেছে।

পিয়ালী মিত্র রান্না ঘরে গিয়ে খোজ নিলেন,রান্না কতদূর কি হল।পারুল বলল,এইমাত্র তো বাজার নিয়ে এল।

তাড়াতাড়ি কর দিদি আবার বের হবে।

পাঞ্চালী বারান্দায় এসে সুখকে দেখে অবাক হয়।আমার পিসি আমার চেয়ে ওর চিন্তা বেশী।এখানে আসার পর ভালো করে তার সঙ্গে কথা বলেনি।একজন অনাত্মীয়া মহিলার সঙ্গে এমন কি সম্পর্ক হতে পারে যে তার এ্যাক্সিডেণ্টের খবর পেয়ে এমন ভেঙ্গে পড়তে হবে।গোপাল্পুরে মোমোকে দেখেও নি।কিছু একটা রহস্য আছে।পাঞ্চালী কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল,মোমোর কথা ভাবছো?

ভালই হয়েছে তুমি যাচ্ছো।তুমিও একজন ডাক্তার।

তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে মোমো কোথায় আছে মানে হাসপাতালে না বাড়ীতে?

এ্যাক্সিডেণ্ট শুনে এমন সব গুলিয়ে গেল কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি।

আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব কিছু মনে কোরোনা।

সুখ ঘাড় ঘুরিয়ে পাঞ্চালীর দিকে তাকালো।

মোমো আমার পিসি তোমার তো কেউ নয় মানে আমি বলছিলাম কি--।

সুখ হেসে বলল,বুঝেছি তুমি কি বলতে চাইছো।আমি আগেও ভাবিনি জন্ম দিয়েই কেবল সম্পর্ক হয়না।আমার নিজের মামাকেও দেখেছি--।

পিয়ালী মিত্রের গলা পাওয়া গেল,তোরা স্নান করে নে।রান্না হয়ে গেছে।আবার তো বেরোতে হবে।

পান্না বাবু ছুতোর মিস্ত্রীকে দিয়ে গ্যারাজ ঘরটা কাঠের পার্টিশন দিয়ে চেম্বারের উপযোগী করছেন।রোগী পরীক্ষার জন্য একটা কুঠরী মত করা হয়েছে। পথচারী দু-একজন দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছে এখানে কি হবে?পান্নাবাবু তাদের বুঝিয়ে বলছেন,এতে কিছুটা প্রচার হয়ে যাচ্ছে।লোকজন সন্তোষ প্রকাশ করছে কাছাকাছি কোনো ডাক্তার নেই।এটা ডাক্তারখানা হলে ভালই হবে।

ওরা খেতে বসেছে।একটা চেয়ারে বসে পিয়ালী মিত্র তদারক করছেন।দীপার কথা ভেবে মনটা খারাপ।বিয়ে-থা করলে আজ দেখাশুনার লোকের অভাব হতো না।

পাঞ্চালী জিজ্ঞেস করল,কি ভাবছো?তুমিও তো বসে যেতে পারতে।

তোরা কবে ফিরবি?

দাঁড়াও এখনো গেলাম না।ওখানে গিয়ে দেখি কি অবস্থা।

যদি রাজি হয় এখানে নিয়ে আসিস।কাছেই দার্জিলিং কদিন ঘুরে গেলে ভালো লাগবে।

কলেজ কামাই করে আসবে কিনা জানি না। রাজি হলে তো নিয়ে আসবো।

পাঞ্চালী লক্ষ্য করে ও মুখ গোমড়া করে চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে।মোমোর জন্য ওর অভিভুত হওয়া খুব দৃষ্টিকটু লাগে।সুখ এমনি সহজ সরল ওর মধ্যে কপটতা নেই পাঞ্চালী জানে কিন্তু এইভাব তার ভালো লাগে না।

পাঞ্চালী স্থির করে শাড়ী পরবে না শালোয়ার কামিজ পরবে।তৈরী হতে থাকে।কলেজে পড়ার সময় তাকে কেউ কিছু বললে তেড়ে মারতে আসতো।লুকিয়ে চুরিয়ে দেখতো।বাড়ীর নীচে ঘোরাঘুরি করতো।পাঞ্চালী কিছুটা কনফিউজড তাহলে কি ভুল বুঝেছে?ইচ্ছের বিরুদ্ধে মোমোর চাপে পড়ে বিয়ে করেছে?

পান্নাবাবু এসে দাড়াতে পাঞ্চালী জিজ্ঞেস করল,কাকু কিছু বলবেন?

এক মহিলা তার বাচ্চাকে নিয়ে এসে কান্না কাটি করছে।তুমি কি একবার দেখবে?

আসতে না আসতেই খবর হয়ে গেছে?কি হয়েছে কি?

বাচ্চাটার কানে যন্ত্রণা হচ্ছে কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না।

আচ্ছা ঠিক আছে যান আমি আসছি।

পাঞ্চালীর খারাপ লাগে না বেরোবার আগে একটা ভালো কাজ করে বেরোবে।মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে জানলা দিয়ে উকি মারতে দেখল,এক মহিলা বাচ্চা কোলে দাড়িয়ে,বাচ্চাটি কেদে চলেছে।মহিলা তাকে থামাতে চেষ্টা করছে।ওদের ঘিরে ছোটোখাটো একটা ভীড় জমে গেছে।পাঞ্চালী মুখ বাড়িয়ে বলল,কাকু ওকে ভিতরে নিয়ে আসুন।আর ঐ রিক্সাওলাকে দাড়াতে বলুন আমরা বের হবো।

বাচ্চাটা কোলে নিয়ে মহিলা ভিতরে এলে পাঞ্চালী দেখল,কানে জব জব করছে সর্ষের তেল। বলল,এত তেল দিয়েছেন কেন,মুছে ফেলুন।

মহিলা আঙ্গুলে আচল পেচিয়ে কানের তেল মুছে ফেলল।পাঞ্চালী ভালো করে পরীক্ষা করে বুঝলো কানে কিছুই হয়নি।পেটের গোলমালের জন্য হয়তো কানে যন্ত্রণা হচ্ছে।সুখ তৈরি হয়ে দরজার কাছে এসে দাড়িয়েছে পাঞ্চালীর নজরে পড়ে।ব্যাগ খুলে একটা হজমের ট্যাবলেট বাচ্চাটাকে খাইয়ে দিল।কিছুক্ষন পর বাচ্চাটির কান্না থেমে গেল।

বাচ্চার কানে কিছু হয়নি।পেটের গোলমালের জন্য কানে যন্ত্রণা হচ্ছিল।

বাচ্চাটীর মা আশ্বস্থ হয়ে হেসে বলল,ম্যাম আপনা ফিজ?

ফিজ দিতে হবে না।আমি এখনো ডাক্তারী শুরু করিনি।

সুখর ভালো লাগে। ড মিত্রও বহু রোগীর কাছে ফিজ নিতেন না।পাঞ্চালীও ওর বাবার মতো হয়েছে। পাঞ্চালি বাইরে বেরিয়ে দেখল ভীড় ফাকা রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে।পান্নাবাবুকে বলল,কাকু আমরা আসছি।মামণি রইল দেখবেন।

তুমি কোনো চিন্তা কোরণা কাজ মিটিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।পান্নাবাবু বললেন।

পাঞ্চালী রিক্সায় উঠে বসল।সুখ এসে দাঁড়িয়ে থাকে।

কি হোল ওঠো,ট্রেন কি তোমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে?

কোথায় বসব?

পাঞ্চালী দেখল দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে সে বসেছে।লজ্জা পেয়ে বলল,কি করব আমাকে কি রোগা হতে হবে।

সুখ রিক্সায় উঠতে উঠতে বলল,তুমি এমন কিছু মোটা নও বরং স্লিম বলা যেতে পারে।তোমার--।

তার ভারী পাছার ইঙ্গিত করছে বুঝে পাঞ্চালী বলল,থাক হয়েছে।মেয়েদের হিপ একটু ভারী হয়।উঠে চেপে বোসো।

সুখ ফাকের মধ্যে বসে পড়তে জায়গা হয়ে গেল।মোমোর পাছাও এমনি ভারী ছিল।পাঞ্চালীর গায়ে মিশে আছে।

পিয়ালী মিত্র জানলায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে থাকেন।পৌছে ফোন করবি।

রিক্সা চলতে শুরু করে।পাঞ্চালী আড়চোখে সুখকে দেখে।কেমন আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে।এই কি ওর স্বামী।পাঞ্চালী থাকতে না পেরে বলল,তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

খুব জরুরী কথা?

সত্যি করে বলতো--

দেখো মিথ্যে বলতে আমার লজ্জা হয়।

তুমি কি আমায় ভালোবাসো না?ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করে পাঞ্চালী।

I love you বললে ভালোবাসা হবে।

এতদিন পরে দেখা হোল ভেবেছিলাম তুমি আমাকে একবার অন্তত জড়িয়ে ধরবে--।

তোমাকে ভালোবাসি বলেই তো সমস্যা।

মানে?

পাঞ্চালী তোমার পাশে যে লোকটা বসে আছে তাকে তুমি কতটুকু চেনো?

কতটুকু আবার কি।লোকটা গোয়ার গোবিন্দ গুণ্ডা আমার ইহকাল আমার পরকাল-- খুব ভাল করেই চিনি।

লোকটার আসল পরিচয় জানলে তূমি পাশে বসতে দিতে না --

আমি বিশ্বাস করিনা।

ঠীক আছে রিক্সায় বসে এসব ভালো লাগছেনা।

পাঞ্চালীর মনে হল মূল সমস্যার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।চাপাচাপি করার দরকার নেই সময় হলে ঐ আপনা হতে সব বলবে। মোমোর সঙ্গে actually relation টা কি তারও মনে কৌতূহল কম নেই।

সহৃদয় পাঠক একটি দুঃসংবাদ দিতে হচ্ছে।অধ্যাপিকা দীপশিখা মিত্র সহকর্মী এবং ডাক্তারদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে গভীর রাতে সহকর্মীদের চোখের জলে ভাসিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। শ্রীমতী মিত্রের আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেও অবশেষে সহকর্মীরা বিশেষ করে অধ্যাপিকা শুক্লা বসু চৌধুরী উদ্যোগী হয়ে শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করলেন।

ঈশানী প্রথমদিন গেছিল পাশেই হাসপাতাল।ম্যাডাম তখন বেহুশ।মুখটা ছ্যাতরায়ে গেছে।মৃত্যুর খবর পেয়ে দিশাহারা বোধ করে।সে এখন কোথায় যাবে কে তাকে মাইনে দেবে ভেবে কূলকিনারা পায়না।সাহেবরে কয়েকবার ফোন করে নাগাল পায়নি।কাল সকালে অবশ্য পেয়েছিল।সাহেব হয়তো আসতে পারে সেই আশায় বসে আছে।দাহ করে এসে একজন ম্যাডাম এসেছিলেন।আশপাশের কয়েকজন খোজ নিতে এসেছিল।এক ফ্লাটের একজন কাজের কথাও বললে ঈশানী কিছু বলেনি।কাজ তো কোথাও না কোথাও করতে হবে।

বাস চলাচল শুরু হয়েছে।ঈশানি বিছানা ছেড়ে উঠে বসল।কলিং বেল বাজতে বিরক্ত হয়।সব দুঃখ প্রকাশ করতে আসছে।আমি কাজের লোক ম্যাডামের কেঊ হইনা আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে কি হবে।যে যাবার সেতো চলে গেছে।ঈশানী উঠে দরজা খুলতে গেল। দরজা খুলে চমকে ওঠে সামনে দাঁড়িয়ে থম্থমে মুখ সাহেব।

আপনি তো আমাকে বলেননি?

মারা গেলেন দুপুরে,কলেজের লোকজন--আমার কি তখন মাথার ঠিক আছে।

ভিতরে চলো।পাঞ্চালী বলল।

হ্যা আপনেরা বসেন আমি চা করতিছি।ঈশানী রান্না ঘরে চলে গেল।

সুখ ঘরে ঢুকে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল।পাঞ্চালী বুঝতে পারে কাদছে।কৌতূহল বাড়ে কি এমন সম্পর্ক ছিল মোমো তো ওর কেউ নয়।মোবাইলে বাটন টিপতে ওপাশ হতে শোনা গেল,হ্যা বল--।

মামণি মোমো আর নেই।

কিছুক্ষন স্তব্ধ তারপর শোনা গেল,কি হয়েছিল?

বাস থেকে নামতে গিয়ে ট্রামের মুখে পড়ে তারপর ঘেষটাতে ঘেষ্টাতে অনেকটা নিয়ে গেছিল।রাস্তার লোকজন নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়,খবর পেয়ে কলেজের লোকজন আসে--।

পাপের ফল--।

কি বলছো এসব?

তুই জানিস না তোকে বলিনি। তোর দাদুর সঙ্গে যা ব্যবহার করেছে--।

আচ্ছা ঠিক আছে রাখছি।পাঞ্চালী ফোন কেটে দিল।

ঈশানী একটা ট্রেতে দু-কাপ চা নিয়ে ঢুকতে পাঞ্চালি ট্রেটা নিয়ে সুখকে ডাকে,এই ওঠো।চা নিয়ে এসেছে।

সুখ পাশ ফিরে চোখ মেলে তাকাতে পাঞ্চালি বলল,দেখো জন্ম মৃত্যুতে আমাদের হাত নেই।ওঠো চা খেয়ে স্নান করে নেও শরীর ঝরঝরে লাগবে।

সুখ উঠে বসে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিল।

আমার পিসি আমার কি খারাপ লাগছে না?

চায়ে চুমুক দিয়ে সুখ বলল,খারাপ লাগছে শেষ দেখাটা হল না।

সেতো লাগবেই।

কলেজে জয়েন করাটাই ভুল হয়েছে।আমি থাকলে এদিন দেখতে হতো না।

তুমি থাকলে কি হতো?রাস্তায় এক্সিডেণ্ট হয়েছে তুমি কি করবে?

সে তুমি বুঝবে না।

মৃত্যুর খবরটা ঈশানী জানায়নি।অবশ্য জানালেই বা কি হতো।অতদূর থেকে আসা কি করে সম্ভব।মহিলা কেমন ঘুর ঘুর করছে সুখ বিরক্ত হয়।সুখ জিজ্ঞেস করল,আপনি কিছু বলবেন?

পাঞ্চালীর দিকে এক নজর দেখে ঈশানী বলল,না কি আর বলব?

এর হাতে বাড়ি রেখে যাওয়া ঠীক হবে না।সুখ মনে মনে স্থির করে সে আর ফিরবে না।সব ঘটনা জানার পর পাঞ্চালীও তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে বলে মনে হয়না।কলকাতায় থেকে আবার পরীক্ষা দেবে।মোমোর সঙ্গে তার জয়েণ্ট এ্যাকাউণ্ট কটা দিন চালিয়ে নেওয়া যাবে।তার আগে ঈশানীকে বিদায় দেওয়া দরকার।চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরালো সুখ।পাঞ্চালী আড়চোখে দেখে অন্যদিকে মুখ ফেরালো।

আমি স্নানটা সেরে নিই।পাঞ্চালী বাথরুমে ঢুকে গেল।

নিজেকে অনাবৃত করে কমোডে বসে নিজের শরীরের প্রতি চোখ বোলাতে থাকে।কোমরের নীচে নজর পড়তে রিক্সায় বসার কথা মনে পড়তে ঠোটে হাসি ফোটে।রিক্সায় দুজনে খুব চাপাচাপি করে বসেছিল।তার নিতম্ব একটু ভারী পাঞ্চালী বুঝতে পারে।ওর পেনিসটাও বেশ বড় মনে হয়।কোনো কৃত্রিম উপায়ে করেনি তো?আমাকে তুমি কতটুকু চেনো বলার পর থেকে এইসব আবোল তাবোল চিন্তা মাথায় আসছে। তলপেটের নীচে হাত দিয়ে বোঝে সেভ করা দরকার কাটার মত বিধছে।পিসির মৃত্যু তাকে আহত করেছে কিন্তু সুখর এতখানি ভেঙ্গে পড়া বিসদৃশ লাগে।মোমোর সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ হল। এমনিতে সুখ লাজুক প্রকৃতির মেয়েদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারেনা।মোমোর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক ছিল নাতো! কথাটা মনে হতেই চমকে ওঠে।নিজেকে শাসন করে ছিঃ এসব কি ভাবছে?

সাহেব একা ছিল ভেবেছিল কাজটা সেরে ফেলবে ভদ্রলোক আসায় ঈশানী বিরক্ত হয়।বৈঠকখানা ঘরে বসে সুখ কথা বলে।

আমি প্রদোষ লাহিড়ী ডি ব্লকে থাকি আপনারা এসেছেন শুনে দেখা করতে এলাম।ভদ্রলোক কাসতে থাকেন।

আমি সুখ রঞ্জন--।

আপনাকে চিনি।এখন তো আপনিও কলেজে অধ্যাপনা করেন।

আমরা আজ সকালে এসেছি।

একদিন আগে এলে দেখা হতো ভেরি স্যাড।অতবড় ডাক্তারের বোন প্রফেসর মিত্র অথচ শেষ সময়ে পাশে কেউ নেই--।আবার কাসি।

ওর ভাইঝি এসেছেন।আপনাকে অসুস্থ মনে হচ্ছে।

হ্যা কদিন ধরে একটু জ্বর জ্বর।

ডাক্তার দেখান নি?

দেখিয়েছি ওষূধ খাচ্ছি।কোনো পরিবর্তন নেই আজকাল ডাক্তাররা যা হয়েছে।একটু কেসে বললেন,ওর সহকর্মীরা ছিলেন সারাক্ষন কলেজে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন।কি জানেন মৌলালীর মোড়ে টার্নিং পয়েণ্টটা বিপদজনক।প্রফেসর মিত্র বাস নামতেই ট্রামের মুখে পড়লেন।বয়স হয়েছে--।

পাঞ্চালী স্নান সেরে প্রবেশ করতে কথা থেমে যায়।

সুখ বলল,উনি প্রদোষবাবু পাশে থাকেন।তোমার পিসির মৃত্যুতে সমবেদনা জানাতে এসেছেন।আর ইনি ড.মিত্র।

দুজনে প্রতি নমস্কার করল।সুখ বলল,দেখোতো ওর কি হয়েছে, উনি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন।

একেবারে ছেলে মানুষ উনি কিছু বলে নি ওর গরজ বেশী।পাঞ্চালী বলল,ঠিক আছে দেখছি তুমি স্নানে যাও।

সুখ চলে গেল পাঞ্চালী ঘরে গিয়ে এ্যাটাচি নিয়ে ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল,সমস্যা কি আপনার?

কাসি হচ্ছে বুকে ভীষণ ব্যথা--।

পাঞ্চালী স্টেথো দিয়ে বুকে পিঠে লাগিয়ে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করে,ডাক্তার দেখান নি?

দেখিয়েছি ম্যাম তিনদিন হয়ে গেল সেই আগের মতই আছে।আপনার বাবা কত বড় ডাক্তার ছিলেন--।

কথা নাবলে বড় বড় করে শ্বাস নিন।পাঞ্চালীর মনে হোল বুকে কফ জমেছে।প্যাড বের করে ওষূধ লিখতে লিখতে বলল,ওই ওষূধ বন্ধ করে এগুলো নিয়ম করে খাবেন।

ওহ খুব উপকার হল।কাসিটা কিছুতেই যাচ্ছে না--

উপকার কোথায় হল ওষূধগুলো খান দেখুন কি হয়।

এখুনি কিনে খাচ্ছি ।আসি ম্যাম।প্রদোষবাবু চলে গেলেন।

পাঞ্চালী মনে মনে ভাবে ভালো হাজব্যাণ্ড হয়েছে তার।​
Next page: Chapter 30
Previous page: Chapter 28